Tuesday, November 13, 2007

প্র তি ক্রি য়া: ভাষার আগুনে ঘি এবং বাংলার ভবিষ্যৎ

.
প্রথম আলোর ৬ নভেম্বর সংখ্যায় অধ্যাপক মেহতাব খানম নাটকের ভাষা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর ৮ নভেম্বর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সে ভাষার ‘আগুনে দু ফোঁটা ঘি’ ঢালার চেষ্টা করেছেন। ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার কিছু বলার আছে বা বলা উচিত বোধ থেকেই এ লেখা। বিতর্কটা অনেকদিন থেকেই চলছে, বিশেষ করে একান্নবর্তী ধারাবাহিক এবং ব্যাচেলর মুক্তি পাওয়ার পর। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো এবং এইচএসবিসির উদ্যোগে যে ‘ভাষা প্রতিযোগ’ হয় প্রতিবছর, সেখানে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই যে অভিযোগ উপস্থাপন করে, তা হচ্ছে শহুরে কথ্য ভাষা বাংলা নাটকে প্রয়োগ করা উচিত কি না? এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি শিল্পের দায়বোধ, অন্যটি ভাষাপ্রেম বা ভাষার পরিবর্তন বিষয়ে উদ্বেগ। মেহতাব খানম দ্বিতীয়টি নিয়ে লিখেছেন, ফারুকী প্রথমটি নিয়ে, আমি দুটি বিষয়কে ধরে একটু অন্য বিষয়ে যেতে চাই।
উনিশ শতকে বাংলা নাটকে (প্রহসনে) মধুসুদন দত্ত যখন মুখের ভাষা প্রয়োগ (মূলত আঞ্চলিক বাংলা) করেন তাঁর বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ এবং একেই কি বলে সভ্যতায়, তখন সমালোচকেরা নিন্দার কাঁটা দিয়ে কম খোঁচাননি। কিন্তু পরে শিল্পবোদ্ধারা এর স্বীকৃতি দেন। এমনকি আজও মধুসুদনের সে কাজকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। একই প্রসঙ্গে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের কথাও উল্লেখ করা যায়। সে হিসেবে আমাদের টিভি নাটকে যে নাগরিক বাংলা বা শহুরে কথ্য ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে, তা কিন্তু এসব নাটকের লেখক বা নির্মাতাদের তৈরি কোনো কৃত্রিম ভাষা নয়। আইছি, খাইছি জাতীয় ক্রিয়াপদ বহুল ব্যবহূত। নাট্যকার বা নির্মাতারা চরিত্রগুলোকে বাস্তবানুগ করার লক্ষ্যেই তাদের মুখে এ ধরনের সংলাপের ব্যবহার দেখাচ্ছেন। আবার এই একই চরিত্র যখন চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যায়, তখন প্রমিত বাংলায় কথা বলে। শিল্প এবং ভাষার বিচারের দিক থেকে এটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করি না।
আমরা ভাষার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি, আমাদের শিশুরা প্রমিত বাংলা আয়ত্ত করুক তা আমরা সবাই চাই। তা ছাড়া প্রমিত বাংলা আত্মবিশ্বাসেরও জন্ন দেয়। কিন্তু আকাশসংস্কতি, তথ্যপ্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের এই সময়ে তরুণ প্রজন্েনর বদলাবেই, আগের প্রজন্েনর মতো থাকবে না, তাই তাদের ভাষাও বদলে যাবে।
ব্যক্তি মানুষ ভাষাকে বদলাতে পারে না, ভাষা বদলে যায় সমাজের দ্বারা; একদিনে নয় অনেক দিনে; ব্যবহারে, অভ্যাসে ধীরে ধীরে বদলায়। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে মুখের ভাষায় লেখা হতো না। মুখে ছিল চলিত আর সাহিত্যের ভাষা ছিল সাধু। এই সাধু ছেড়ে মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য প্যারিচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ কম গালমন্দ শোনেননি। পরে সবুজপত্র (১৯১৪) খ্যাত প্রমথ চৌধুরী মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সাধু ভাষা ছেড়ে চলিত ভাষায় লিখেছিলেনশেষের কবিতা এবং তাঁর উপন্যাসের মধ্যে এটি অধিক পঠিত ও জনপ্রিয়। প্রমথ চৌধুরী ভাষাকে মানুষের মুখ থেকে কলমে নিতে চেয়েছিলেন (উল্টোটা করতে গেলে মুখে কালি লাগে) বিশ শতকে এসে ধীরে ধীরে সাধু ছেড়ে চলিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের ভাষা আর এ কালে এই একুশ শতকে সাধু ভাষার স্থান হয়েছে লাইব্রেরি কিংবা জাদুঘর। এভাবেই ভাষার বদল ঘটে।
একুশ শতক শেষে পৃথিবীতে কয়টি ভাষা টিকে থাকবে এই জরুরি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করে ভাষাবিজ্ঞানীরা তিনটি ভাষার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন−এগুলো হচ্ছে চীনা, ইংরেজি ও হিন্দি। হয়তো আরও কিছু ভাষা টিকবে এবং সে তালিকায় বাংলা থাকবে কি না সে অপেক্ষার বিষয়। কিন্তু এ কালে যে বাঙালির সন্তান বাংলা ভাষার লোকসাহিত্য, রূপকথা পাঠ ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমা হ্যারি পটারের স্বপ্নে বিমোহিত হচ্ছে মেহতাব খান ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এ আশঙ্কার সঙ্গে যেমন আমি একমত, তেমনি আমাদের প্রিয় বর্ণমালা অ-আ-ক-খ ছেড়ে রোমান হরফে (ইংরেজি নয়) ডিজুসীয় বাংলার প্রচলন বাড়ছে এবং কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আমাদের এ সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কি আমাদের কিছুই করণীয় নেই? গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের একটা সামাজিক দায় ও ভাষাপ্রেম থাকা উচিত, যা দিয়ে সে রোমান হরফে বাংলা লেখা ছাপা যাবে না ঘোষণা দিতে পারে।
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভাষা তার স্বাভাবিক নিয়ম ও গতিতে চলে, পরিবর্তিত হয়, বহতা নদীর মতো এগিয়ে চলে। কখনো গ্রহণ করে, কখনো বর্জন করে। ভাষিক সমাজে বসবাসরত মানুষ নিজের অজান্তেই পাল্টে ফেলে ভাষা (কখনো কখনো রাষ্ট্রের উদ্যোগে সচেতনভাবেও ভাষায় পরিবর্তন আনা হয়−বাহাছা মালয়েশিয়া যার উদাহরণ)। ভবিষ্যতে আমাদের নাগরিক সমাজ যদি প্রমিত বাংলা ছেড়ে ‘আইছি’ (আসিয়াছি>এসেছি>আইছি) ‘গেছি’ জাতীয় ভাষা প্রয়োগ শুরু করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভাষা মূলত বেঁচে থাকে মানুষের মুখে, মুখের ভাষাকে নিয়ম বেঁধে ঠেকানো যায় না। তাহলে প্রাকৃত নয় মৃত সংস্কৃতই টিকে থাকত। শুধু বাংলা কেন সব ভাষাতেই কি পরিবর্তন ঘটছে না। আমাদের ভাষাপ্রেম আছে, থাকবে, বদলটাকেও স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে।

সৌরভ সিকদার: শিক্ষক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৩ নভেম্বর ২০০৭
.

No comments: