Thursday, November 8, 2007

প্র তি ক্রি য়া: ভাষার আগুনে দু ফোঁটা ঘি

.
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শ্রদ্ধেয়া মেহতাব খানমকে ধন্যবাদ। ৬ নভেম্বর প্রকাশিত ‘টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার’ লেখাটার জন্য। লেখাটি চিন্তার উদ্রেককারী। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার যথেষ্ট অনুপ্রেরণা লেখাটির মধ্যে রয়েছে।
তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে আটপৌরে ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন, বলতে দ্বিধা নেই, ঘটনাচক্রে আমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ফলে অভিযোগের দায়টা আমার ওপরেও এসে পড়ে। কানামাছি নামে একটা ভিডিও ছবিতে আমি সর্বপ্রথম কথ্যভাষার প্রয়োগ শুরু করি। এরপর ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করি চড়ুইভাতিতে। তারপর টিভি ধারাবাহিক একান্নবর্তী, সিক্সটি নাইন এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ব্যাচেলার-এ। সেই তাড়না থেকেই লেখা।
মেহতাব খানের লেখাটির দুটি দিক আছে। ভাষাতাত্ত্বিক ও চলচ্চিত্রগত। ভাষাতাত্ত্বিক দিকটা হলো, এত প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে ভাষা পেয়েছি সেই বাংলার ভাষায় হিন্দি, ইংরেজি ও আঞ্চলিকতার মিশেল চলতে থাকলে সেটা উদ্বেগেরই ব্যাপার। আমিও অংশত এই উদ্বেগের সঙ্গে একমত। এখনকার শিশু-কিশোরেরা যে হারে হ্যারি পটার, পকিমন ও ভিডিও গেমসের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমাদের যে রূপকথা-উপকথা রয়েছে, আজকের কিশোরেরা এর নাগালও পাচ্ছে না। তারা ঠানদিদির থলের চেয়ে ‘ডেথ অব হ্যালোজ’-এর কুয়া চেনে বেশি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ছেলেরা জাতীয় সংগীতের চারটা লাইনও বলতে পারবে না। সাত বীরশ্রেষ্ঠর নামও জানবে না। এরা হরিপদ কাপালি, পলান সরকারকেও চিনবে না। মনে-মগজে থাকবে আমেরিকা-ভারত। হিন্দি অথবা ইংরেজি। তথাকথিত বিশ্বায়নের খপ্পরে পড়ে ছোট জাতিগুলোর পক্ষে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন হবে। সংস্কৃতির এই যুগে টিকে থাকতে গেলে আমাদের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে মিডিয়াকে দ্বিগুণ শক্তিশালীরূপে আবির্ভুত হতে হবে।
কিন্তু আঞ্চলিকতা বহিরাগত কোনো ব্যাপার নয়, এটা যেকোনো ভাষারই অন্তর্গত ব্যাপার। আঞ্চলিকতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কিছু নেই। আঞ্চলিকতা ভাষারই অলংকার। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গে বাংলা ভাষা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষায় রয়েছে অঢেল বৈচিত্র্য। আঞ্চলিকতা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। তাই বলে সংবাদ উপস্থাপন, নিউজ রিপোর্টিং, অনুষ্ঠান উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাকে টেনে আনা চলে না। সব ভাষারই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রকাশভঙ্গি আছে। দুটোর ব্যবহার দুই ক্ষেত্রে। অনুষ্ঠান উপস্থাপক যদি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাষা মিলিয়ে উপস্থাপনা শুরু করেন, তাহলে অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার হবে। মেহতাব খানম বোধ হয় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাষা এক করে ফেলেছেন। ভেবেছেন, সংবাদ যেমন আনুষ্ঠানিক ভাষায় উপস্থাপিত হয়, চলচ্চিত্রেও তেমনটাই হওয়া উচিত। চলচ্চিত্রে বা টিভি মিডিয়ায় (যেটাকে তিনি টিভি নাটক বলেছেন, আসলে ভিডিও ছবি বা ডিজিটাল সিনেমা) ভাষার প্রয়োগ কী রকম হবে, সেটা ঠিক করতে হলে আগে জানতে হবে চলচ্চিত্রের দর্শন। এক কথায়, যে চরিত্র যে ভাষায় কথা বলার কথা, যে চরিত্রের জন্য যে পোশাক দরকার, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে তাকে সে ভাষাতেই কথা বলতে দিতে হবে, সেই পোশাকই পরাতে হবে। ৮০ বছরের বয়স্ক চরিত্রের জন্য যেমন আট বছর বয়সী শিশু উপযুক্ত নয়, নারীর চরিত্রের জন্য যেমন কোনো পুরুষকে মনোনীত করার সুযোগ নেই, তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও এই ডিটেইল রক্ষা করা জরুরি। আমরা পোশাকে, বয়সে, লিঙ্গের ব্যাপারে বাস্তববাদী হব, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে হব না−তা কীভাবে সম্ভব?
মেহতাব খানম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অনেক আঞ্চলিক ভাষা থাকার কারণে আমরা নাটকের ডায়লগে সেগুলো প্রায়ই শুনতে পাই এবং সে পর্যন্ত থাকাটা ঠিকই আছে। সেই সঙ্গে যদি শুদ্ধ বাংলার চর্চাও কমে যায়, তাহলে আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারি।’ এ অংশটুকুর মর্ম আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা, তিনি বলতে চেয়েছেন, বরিশালের গল্প বরিশালের ভাষায় করা যাবে, কুষ্টিয়ারটা কুষ্টিয়ার ভাষায় কিন্তু ঢাকা শহরের গল্প হলে সেটাতে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে হবে। কে আমাদের বলে দিল ঢাকার প্যান্ট-শার্ট পরা সব মানুষ অভিন্ন মান বাংলায় কথা বলে? দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ঢাকায় এসে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা নতুন ধরনের কথ্যভাষার (মেট্রোপলিটন কলোকুয়ালের) জন্ন দিচ্ছে। এটার ব্যাপক বাস্তব রূপকে অস্বীকার করে একটা বানোয়াট বাস্তবতা তৈরি করলে তো হবে না। আবার এটাও ঠিক, কেউ কেউ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। আমার কাজগুলোর মধ্যে এ রকম বহু চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। যে টিভি ধারাবাহিকটার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন কিন্তু নাম বলেননি, সেই একান্নবর্তীতেও অনেকে প্রমিত বাংলায় কথা বলেছে। আমার সর্বশেষ ভিডিও ছবি ওয়েটিং রুমেও বলেছে। আবার অশুদ্ধ (!) ভাষাতেও বলেছে। যদিও আমি এটাকে অশুদ্ধ বলি না। বলি, কথ্য। আবার যারা আমার ছবিতে কথ্য ভাষায় কথা বলে, তারাও কখনো কখনো প্রমিত বাংলায়ও কথা বলে। ধরা যাক, নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে, তখন। অর্থাৎ বাস্তব জীবনে আমরা যেমনটা করি। আসলে ভাষা ব্যবহারের পুরোটাই পরিস্িথতি অনুযায়ী ঘটে।
শিশু-কিশোরেরা জগাখিচুড়ি ভাষা শিখে ফেলবে এই ভয়ে আমি আমার চরিত্রের ভাষা বদলে দেব? ধরা যাক, আমি একজন যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিকে নিয়ে ছবি বানাব। এখন যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে ছবি বানাতে গেলে তাঁর চরিত্রের অনেক খারাপ দিক, ঘৃণ্য দিক নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে হবে। কথা হচ্ছে, এসব খারাপ ক্রিয়াকর্ম দেখে কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা প্রভাবিত হয়ে খারাপ পথে ধাবিত হতে পারে−এই আশঙ্কা থেকে আমি কি যুদ্ধাপরাধীর চরিত্রের সব কালো দিক ধুয়ে ফেলে শুধু সাদা দিকগুলো দেখাব? এটা কি চলচ্চিত্রকারের দায়িত্বের আওতায় পড়ে? এটা যেমন তাঁর দায়িত্বের আওতায় পড়ে না, তেমনি তিনি চাইলেই কারও মুখে ‘ভালো ভাষা’ বসিয়ে দিতে পারেন না। অর্থাৎ কারও ওপর সদ্গুণ আরোপ করা কিংবা ‘সদ্ভাষা’ চাপিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্রকারের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না।
এবার ভাষা এবং ভাষার বিবর্তন বিষয়ে দুটো কথা বলতে চাই। ভাষা কোনো স্নৃতিসৌধের বেদির মতো অটল এবং স্িথর নয়। ভাষা বহতা নদীর মতো−এই উদাহরণ আমরা মুখে যতটা আওড়াই, মন দিয়ে ততটা বিশ্বাস করি বলে মনে হয় না। মান বাংলা পাল যুগে যে চেহারায় ছিল, ফোর্ট উইলিয়ামের কালে সে জায়গায় ছিল না। ফোর্ট উইলিয়ামের কালে যে জায়গায় ছিল, রবীন্দ্রনাথের কালে সে চেহারায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সময় যে জায়গায় ছিল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কালে আর সেখানে নেই। এই যে বিবর্তনটা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, এর বড় অনুঘটক হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষা, কথ্য ভাষা। এটা এমন নয় যে এটা সব সময়ই কিংবা পুরোটাই গবেষকের টেবিলে বিবর্তিত হয়। মানুষের মুখে মুখে বিবর্তিত হতে হতে অভিধান নতুন নতুন শব্দ পায়। ফলে কোনো একটা মান ভাষা আঁকড়ে ধরে ‘ভাষা-শাসন’ করা যায় না। অভিন্ন মান ভাষা অবশ্যই থাকবে। তবে তা স্িথর কিছু নয়, বিবর্তিত হবে এবং তা বহুলাংশে হবে রাস্তার বা মানুষের মুখে, গবেষকের টেবিলে নয়।
শেষ করতে চাই একটা শোনা কথা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের কালে বিশুদ্ধবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে প্রায়ই গালমন্দ করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বাংলা ভাষার বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার। একবার নাকি বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের কোনো একটা গল্পের একটা অনুচ্ছেদ হুবহু তুলে দিয়ে ছাত্রদের বলা হয়েছিল, লেখার ভুলগুলো সংশোধন করতে! সে প্রশ্ন রচনাকারী আজ কোথায়, বিদ্যালয় কোথায়, পরীক্ষা কোথায়, পরীক্ষার্থীই-বা কোথায়, আর রবীন্দ্রনাথ কোথায়!

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: চলচ্চিত্র নির্মাতা। ৮ নভেম্বর, ২০০৭
.

No comments: