Friday, April 11, 2008

বন্ধুদের স্মৃতিতে

ফয়জুল ইসলাম
--


গত ২৩ মার্চ ২০০৮ এ বাংলা কথাশিল্পের অনন্য একজন রূপকার শহীদুল জহির মৃত্যুবরণ করেছেন। নিভৃতচারী এ লেখকের বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। জানা যায়, ৭০ দশকের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় তিনি চার-পাঁচ জনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন। কিš' তাঁর সে সময়কার বন্ধুদের কোনো খবর আমরা জানিনা। লেখকের জš§স্থান পুরানো ঢাকার ভূতের গলি এলাকার বন্ধুদের খবরও আমাদের অজানা। একইভাবে আমরা জানিনা, তাঁর পৈতৃক বাড়ি মগবাজার নয়াটোলা-তে কারা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর কারো কারো সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। লিখালিখির সূত্রে কেউ কেউ তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন বলে আমরা জানি।
শহীদুল জহিরের ছোট ভাই হাবিবুল হক ফোনে আমাকে বলেছিলেন - আসলে শহীদ ভাইয়ের অনেক ধরনের বন্ধু ছিল, যদিও বা হাতে গোনা। তাঁর বন্ধুবৃত্তকে বিভিন্ন কমপার্টমেন্টে ভাগ করা যায়। হাবিবুল হকের সাথে ঐক্যমত্য না হয়ে পারা যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চাকরিসূত্রে যারা শহীদুল জহিরের কাছে এসেছিলেন এদের বেশির ভাগই তাঁর গল্প বা উপন্যাস পড়েননি। এরকম কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের কারণ লেখকের ব্যক্তিচরিত্র। সচারাচর তিনি কারো সাথেই খোলামেলাভাবে মেশার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না। ব্যতিক্রম ঘটেছিল সেসব মানুষের ক্ষেত্রে যারা কোন না কোন কারণে তাঁর আশেপাশে ছিলেন এবং সে নৈকট্য ছাড়াও যারা সাহিত্যিক অথবা সাহিত্যানুরাগী। বন্ধুদের এ দলটির সাথে শহীদুল জহিরের মনোজাগতিক যোগাযোগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ দলের মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ক'জনের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে - আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, খোরশেদ আলম, ওয়াসি আহমেদ, মোহাম্মদ সাদিক প্রমুখ।শহীদুল জহিরের জানাজার নামাজ হয়েছিল বাংলাদেশ সচিবালায়ে যেহেতু তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যš-। জানাজার নামাজ থেকে শহীদুল জহিরের বন্ধু লেখক খোরশেদ আলম তাঁর নিজের অফিসে ফেরার পর আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। আমরা দু'জন চেষ্টা করি মৃত বন্ধুর জন্য শোক ভাগাভাগি করে নিতে। কিš' নৈঃশব্দ ছাড়া কিছুই তখন থাকে না আমাদের দু'জনের সামনে। ৩১ মার্চ ২০০৮ এর দুপুরে খোরশেদ আলম আমাকে তাঁর অফিসরুমে ডাকেন। পরিকল্পনা কমিশনের ১৪ নম্বর ব্লকে আমি ঠিক তাঁর ওপরের রুমে বসি। শহীদুল জহিরকে নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আনিসুল হক, মোহাম্মদ সাদিক, অদিতি ফাল্গুনী এবং ইমতিয়ার শামীমের লেখা তিনি পড়েছেন। লেখাগুলো পড়তে পড়তে শহীদুল জহির সংক্রাš- কিছু স্মৃতি তাঁর মনে এসেছে। খোরশেদ আলম আর শহীদুল জহিরের অনেক আগের কথপোকথন থেকে আমি জানতাম যে তাঁরা সত্তুর দশকের গোড়ার দিকে আগারগাঁ-র সরকারি কলোনির মাঠে বসে বসে আড্ডা দিতেন। কলোনির বি¯-ৃতির কারণে সে মাঠটা এখন সংকুচিত হয়ে পড়েছে।সেটা ছিল ১৯৭৯ সাল। পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তরুণ কর্মকর্তারা অনেকেই তখন আগারগাঁ সরকারি কলোনিতে সাবলেট থাকতেন। খোরশেদ আলমও সাবলেট থাকতেন। কলোনির মাঠটা তখন অনেক বড়। সন্ধ্যার দিকে সেখানে খোরশেদ আলম আড্ডা দিতেন তাঁর বন্ধুদের সাথে। ১৯৭৯ সালের কোনো এক সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে কর্মরত শহীদুল জহির আগারগাঁ কলোনির মাঠে আড্ডা দিতে এসেছিলেন।

তখন তিঁনি তাঁদের মগবাজার নয়াটোলার বাসাতেই থাকতেন। খোরশেদ আলমের সাথে শহীদুল জহিরের প্রথম দেখাটি তেমন অর্থবহ কিছু ছিল না। তরুণদের এই গ্র"পটিই আবার অফিসেও আড্ডা দিত। এভাবেই খোরশেদ আলম আবিস্কার করেন যে শহীদুল জহির একজন লেখক। খোরশেদ আলম তখন আইসাক সিঙ্গারের লেখায় ডুবে আছেন। আইসাক সিঙ্গারের সাহিত্যকর্ম এবং সমকালীন বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁদের আলাপচারিতা শুরু হয়। সেই থেকে ঘনিষ্ঠতারও শুরু। তারপর আড্ডার বিষয়ে ঢুকে পড়ে রাজনীতি ও অর্থনীতি। কিš' শহীদুল জহির নারী বিষয়ক আলোচনায় তেমন একটা ঢুকতেন না।আমরা দেখি, ১৯৮৫তে শহীদুল জহিরের প্রথম গ্রন্থ 'পারাপার' বের হয়েছে। খোরশেদ আলম 'পারাপার'-এর গল্পগুলো মনোযোগ দিয়েই পড়েছিলেন। সে সময়ে আমরা দেখি, খোরশেদ আলমের সাথে শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করছেন; তাঁদের ভেতরে তর্ক-বিতর্কও চলছে।তারপর আমরা দেখি, ১৯৮৭ সালে দৈনিক সংবাদ-এ খোরশেদ আলম আইসাক সিঙ্গারের একটি গল্প অনুবাদ করেন 'ফেরা' নামে। শহীদুল জহির তখন দৈনিক সংবাদের কপি নিয়ে ঢুকছেন পরিকল্পনা কমিশনের খোরশেদ আলমের রুমে; ঢুকেই বলছেন-বিরাট কাজ করেছ! এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন তিনি! তারপর অফিস শেষে তারা দু'জন হাঁটছেন এখনকার রোকেয়া সরণী ধরে শেওড়াপাড়ায় খোরশেদ আলমের বাসার দিকে। শহীদুল জহির তখন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্প অনুবাদ করছেন। কিছু অনুবাদ সম্ভবত দৈনিক সংবাদ-এ ছাপা হয়। শহীদুল জহির তখন আগারগাঁ কলোনি ছেড়ে গ্রীন রোডের গেজেটেড অফিসার্স কলোনিতে উঠে গেছেন যেখানে অবিবাহিত সরকারী কর্মকর্তারা সাধারণত থাকেন। ১৯৮৫-৮৭ পর্যš- আগারগাঁ কলোনির ৪০৩ নম্বর বাসাতে তিনি থেকেছেন। সে বাসাটি ছিল তাঁর সহকর্মী বন্ধু হাবিবের নামে। হাবিবুর রহমান একাই থাকতেন সে বাসাতে। তিনি শহীদুল জহির-কে সে বাসায় থাকার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। আগারগাঁ কলোনি থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের দূরত্ব খুব কম ছিল বলে শহীদুল জহিরের অফিসে আসা-যাওয়া করতে সুবিধা হয়েছিল।এখানেই লিখা হয় তাঁর ছোটগল্প 'আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই'।১৯৮৯ সালে সেবা প্রকাশনী থেকে খোরশেদ আলমের আইসাক সিঙ্গারের অনুবাদ গ্রন্থ বের হয়। সে উপলক্ষে মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের কোনার মাঠে (যে মাঠটা এখন আর নেই) তিনি একটি পার্টি দেন। সেখানে খোরশেদ আলমের অনেক ইয়ারের ভেতরে শহীদুল জহিরও ছিলেন। বিহারি ক্যাম্পের সে মাঠে তখন খোরশেদ আলম নিয়মিত আড্ডা মারতে যেতেন। শহীদুল জহির সেখানে একবারই গিয়েছিলেন মাত্র। একই সময়ে শহীদুল জহির তাঁর দ্বিতীয় বই 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা'-র একটি কপি খোরশেদ আলম-কে উপহার দেন। খোরশেদ আলম চমৎকৃত হয়েছিলেন গল্প পড়ে। তাঁর মনে হয়েছিল, 'পারাপার'-এর শহীদুল জহিরের সাথে 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা'-র শহীদুল জহিরের বি¯-র পার্থক্য - গল্পের বিষয়ে পার্থক্য, কাঠামোতে পার্থক্য, গল্পের বুননে পার্থক্য, ভাষায় পার্থক্য আর পার্থক্য মানবিক আবেদনে। তিনি শহীদুল জহিরকে বলেছিলেন - তোমার গল্প বলার ভঙ্গিটা বদলাতে পার। গল্পটা এমনভাবে বলছ, যেন তুমি দূর থেকে ঘটনাগুলো দেখছ এবং আমাদেরকে তা শোনাচ্ছ।
শহীদুল জহির কোনো বাহাস করেননি। তিনি খোরশেদ আলমকে জানিয়েছিলেন যে গল্পটা জাদুবা¯-বতার ঢঙে লেখা। আলাপ এর চাইতে আর আগায়নি। আজকের খোরশেদ আলম বলেন - জাদুবা¯-বতার কাঠামোতে শহীদ যে এত জাদু লাগিয়ে দেবে, তা তখন আমি ভাবিনি!এভাবে আমরা দেখি, দু'জন সাহিত্যিকের ভেতরে গড়ে উঠছে বন্ধুত্ব। ১৯৯১ সালে শহীদুল জহির খোরশেদ আলমের তাজমহল রোডের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছেন (উল্লেখ্য, শহীদুল জহির সচরাচার কারো বাসাতে যেতেন না)। আরো দেখি, ১৯৯২ সালে হিউবার্ট হামফ্রে ফেলোশিপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরের জন্য যাওয়ার আগে শহীদুল জহির তাঁর গ্রীন রোড কলোনির ২/১০ নম্বর বাসাতে নিমন্ত্রণ করছেন বন্ধু খোরশেদ আলম-কে। তারপর ১৯৯৩ তে আমেরিকা থেকে ফেরার পর সম্ভবত শহীদুল জহিরের পোস্টিং হয় সাভারের পিএটিসি-তে। মাঝখানে প্রায় বছর তিনেক এ দু'লেখকের মাঝে যোগাযোগ কমে যায় যেহেতু শহীদুল জহির তখন পরিকল্পনা কমিশন চত্বরের বাইরে ছিলেন। সম্ভবত ১৯৯৭ সালের দিকের কোন সময়ে শহীদুল জহির বদলি হয়ে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে, যেখানে সবুজ আর সবুজ-জড়াজড়ি করে আছে ইউক্যালিপটাস, বকুল গাছ, ঝাঁকড়া কাঠবাদাম, আমগাছ, কড়-ই, অনেক লাল রঙ্গন আর ঘাসের স্ট্রিপ। আবার নিয়মিত আড্ডা শুরু হয় দুই বন্ধুর (১৯৯৪ সালে শহীদুল জহিরের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। ১৯৯৭ সালে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে ফিরে আসার পর তিনি তাঁর বন্ধু খোরশেদ আলমের মাধ্যমে আমাকে খুঁজে বের করেন। আমি তখন পরিকল্পনা কমিশনে খোরশেদ আলমের পাশের রুমে বসি)। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত শহীদুল জহিরের উপন্যাস 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' তখন আমরা পাঠ করি। 'আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস' ততদিনে পড়া হয়ে গেছে। তার গল্প আমাদেরকে আরো মুগ্ধ করে।১৯৯৭ সালে এ শহীদুল জহির ও খোরশেদ আলমের সখ্যের ১৮ বছর হয়ে গেছে। আমি দেখি, শহীদুল জহির প্রায়ই আড্ডা দিতে আসছেন খোরশেদ আলমের সাথে। শহীদুল জহিরের অফিসরুমে খোরশেদ আলম তেমন একটা যান নাআলসেমির কারণে। তাঁদের দু'জনের ভেতরে আবারো বাংলা সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলছে। তাঁদের আড্ডায় তখন আমিও যোগ দিতে শুরু করি। এ সময়ে শহীদুল জহির লিখছেন 'ধূলোর দিনে ফেরা' আর 'চতুর্থ মাত্রা'-র মতো অসাধারণ গল্প। গল্পগুলো তিনি পড়তে দিচ্ছেন বন্ধু খোরশেদ আলম-কে। আমিও পড়ছি। ১৯৯৯ তে তাঁর 'ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প' প্রাকাশিত হলে আমরা আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুলো ডিসেকশন করেছিলাম বলেই মনে পড়ছে।
১৯৯৭ থেকে মোটামুটিভাবে ২০০৫ পর্যš- এ দু'লেখকের ভেতরে চমৎকার মনোজাগতিক লেনদেন ছিল। ২০০৫-এর পরে দেখা গেল, শহীদুল জহির তাঁর অফিসরুম থেকে বেরিয়ে খুব একটা কোথাও আড্ডা দিতে যাচ্ছেন না। দেখেছি ২০০৬ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যš- শহীদুল জহির নিজেকে তাঁর অফিসরুমে একরকম বন্দী করে ফেলছেন। আড্ডা কমে যাওয়ার কারণে শহীদুল জহিরের 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' ও 'মুখের দিকে দেখি' বই দু'টি নিয়ে খোরশেদ আলমের সাথে তাঁর দীর্ঘ সংলাপ হয়নি বলে জানা যায়।প্রায় তিন যুগের সখ্য লেখক শহীদুল জহির এবং লেখক খোরশেদ আলমের। ২০০৪ এ 'রোববারে'-এ খোরশেদ আলমের একটি উপন্যাস ছাপা হয়। উপন্যাসটির নাম 'এক তাগড়া জোয়ানের যুবতি বউ হারানোর কেচ্ছা'। এ নামটি নিয়ে শহীদুল জহির এবং আমি অনেক মশকরা করেছিলাম এবং আমরা নারী বিষয়ক রসালো আলোচনায় মত্ত হয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য এবং আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এ পৃথিবীর কোনো নারীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। তবে ফ্যান্টাসি? ফ্যান্টাসি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।শহীদুল জহিরের গল্প বলতে বলতে লেখক খোরশেদ আলম এখানেই থেমে যান। আর কোনো জরুরি ইতিহাস তাঁর বলার নাই।খোরশেদ আলম-কে আমি প্রশ্ন করি - ব্যক্তি শহীদুল জহির সম্পর্কে কিছু বলুন।কিছু বলেনও তিনি। তাঁর কথার সারাংশটি এমন : প্রয়াত শহীদুল জহির এত বড় লেখক হয়েও খুব সাধারণ মানুষের ক্যামোফা¬জে থেকেছেন সব সময়। সব সময়ই তিনি ভাবের গভীর জগতে থাকতেন। লিখালিখির ব্যাপারে বরাবরই খুব ফোকাস্ড ছিলেন শহীদুল জহির। লেখক হিসাবে এ পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথেই তিনি সমঝোতা করেননি কখনো। তিনি নিজের মনে লিখতেন। পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের কোনো দায় তিনি অনুভব করেননি। তাই তিনি এক কলম লিখে দীর্ঘদিন বসে বসে ভাবতে পারতেন। তিনি মনে করতেন, তার যেমন ভাল লেখার অধিকার আছে, তেমনই আছে খারাপ লেখার অধিকার। যা ইচ্ছা তাই-ই লিখতে পারেন একজন লেখক। কোনো পত্রিকার সম্পাদক যদি তা না ছাপান, তা'তে কিছু যায় আসে না। আর লেখকদের দলাদলির ভেতরে কখনোই ঢুকতে চাননি শহীদুল জহির। তিনি নির্জন এক দ্বীপ। কোলাহল থেকে দুরে থেকে লিখতে চেষ্টা করেছেন মানসম্মত গল্প আর উপন্যাস।খোরশেদ আলম বলেন - সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে শহীদুল জহিরের একনিষ্ঠতা অতুলনীয়। কিš' শহীদুল জহির তাঁর নিজের জীবনকে এতখানি নিরস না বানালেও পারতেন! নারীসঙ্গ যে সবসময় কাউন্টার প্রোডাক্টিভ হবে - এমনটি ভাবার কোনো কারণ নাই। স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া শহীদুল জহিরের একাকী জীবনের যেসব বিবিধ ভার জমেছিল, মানুষজনের সাথে মন খুলে মিশলে হয়ত তা কমে আসত! শহীদুল জহিরকে খোরশেদ আলম বলেছিলেন -একজন বৈরাগীর জীবনেও তো ব্যক্তিগত ভার লাঘবের সুযোগ থাকে, যেমন আর কিছু না হোক, ক্লাšি-, অবসাদ আর একঘেঁয়েমি কাটাতে একজন বৈরাগী নতুন কোনো লোকালয়ে চলে যেতে পারে বা নাচ-গান করতে পারে অথবা গাঁজা খেতে পারে। শহীদুল জহির তাঁর নিজের তৈরি করা নিরস জীবনযাপনে একটু হলেও আলো-বাতাস আসতে দিয়ে দেখতে পারতেন। খোরশেদ আলমকে শহীদুল জহির নিজেই জানিয়েছিলেন যে ব্যক্তি জীবনে তিনি মোটেই সাহসি মানুষ ন'ন। কাজেই একা থাকার ভার কমানোর জন্য তাঁর পক্ষে আর যাই হোক, বিপ্লব করাটা ভয়ানক কঠিন। আর সে জন্যই নিজের জীবনযাপনের ভারটুকু, বিষটুকু তাঁকেই গলধঃকরণ করে নীলকণ্ঠি হতে হয়েছে বলে খোরশেদ আলমের ধারণা। শহীদুল জহিরের নিরস জীবনযাপনের কোনো প্রয়োজন দেখেননি খোরশেদ আলম ।
কিš' কেন শহীদুল জহির এ নিরস জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন? সেটা কি নিরবিচ্ছিন্ন সাহিত্যসৃষ্টির জন্য? নাকি কোনো নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয়েছিল হƒদয়? সে খবর আরো অনেকের মতই খোরশেদ আলমও জানেন না।খোরশেদ আলম বলেন - শহীদ আমার এত কাছের বন্ধু, কিš' অনেক ব্যক্তিগত বিষয় সে কখনোই আমার সাথে শেয়ার করেনি। ঘনিষ্ঠ হলো না শহীদ! বহুত চেষ্টা করলাম! কাছাকাছি থাকলাম, চল্লাম পাশাপাশি তিরিশ বছর মতো, কিš' মনে হয় সত্যিই তাকে আমি পুরোপুরি চিনতে পরিনি।তবে কি শহীদুল জহিরের তীব্র কোনো অভিমান ছিল? অনতিক্রম্য ক্ষোভ ছিল কোনো? অনেক চেষ্টাতেও শহীদুল জহিরের কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর বের করা যায়নি বলে খোরশেদ আলম জানান। শহীদুল জহির সযতনে তাঁর একাকী জীবনযাপনের কারণ এবং ইতিহাস সম্পর্কে আমাদেরকে কোনো সূত্র দিয়ে যাননি। খোরশেদ আলম যেমন সাহস করে বন্ধু শহীদুল জহিরকে এ একাš- ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্নটি করতে পেরেছিলেন, পরিচিত বেশির ভাগ মানুষই শহীদুল জহিরকে এ প্রশ্নটি করেছিলেন নিশ্চয়। সেটাই স্বাভাবিক, কেননা আমরা মানুষেরা কোনো একটি ঘটনার কার্যকারণ খুঁজি; যতক্ষণ কার্যকারণ খুঁজে না পাই, আমরা অস্ব¯ি-তে ভুগতে থাকি।খোরশেদ আলম আরো বলেন- বন্ধুত্বের একটা সহজ পর্যায়ের পর শহীদুল জহির মানুষের সাথে সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তুলে দিতেন, যে দেয়াল কখনো ভাঙা যেত না; দেয়াল ভেঙে পৌঁছানো যেত না তাঁর আত্মার খুব কাছাকাছি। এই বলেই খোরশেদ আলম শহীদুল জহিরকে নিয়ে তার গল্প শেষ করেন।

জীবন-বাস্তবতা

সুশা¯¦ মজুমদার
___

শহীদুল জহিরের অকাল প্রয়াণ প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের জন্যে বিশাল এক ক্ষতি। নিভৃতে সাহিত্যের বাঁক বদলে দেয়া নীরবচারী এই শব্দশিল্পীকে যুগাš-রের শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং ভালোবাসা
লেখকদের জানাশোনা প্রিয় অঞ্চল থাকে যেখানে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে স্বীয় লেখার জন্য রসদ আহরণ করেন। সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরী, শওকত আলীর দিনাজপুরসহ উত্তর বাংলা, হাসান আজিজুল হকের রাঢ়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরনো ঢাকা, অলিগলি, তার ভেতরে দমবন্ধ চাপা অন্ধকারের সুড়ঙ্গ থাকলেও তিনি ঢুকে পড়েছেন। সদ্য প্রয়াত শহীদুল জহির লক্ষ্মীবাজার, ওয়ারি, নারিন্দা, ভূতেরগলি, আগারগাঁও মহল্লা লাগোয়া মহল্লা, তার আশপাশের বিশদ চালচিত্র তার সাহিত্যের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ এ অঞ্চলসমূহ লেখকের গল্প-উপন্যাস থেকে বেরিয়ে গোটা দেশের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। খণ্ড খণ্ড এলাকা হয়েছে অসংখ্য ভূমিÑ বিশাল বাংলার সমান। এখানকার পশ্চাদভূমি ও তার আখ্যান মানুষের শরিক হওয়ায় পাঠকের নিজেরও বিষয় হয়ে আগ্রহের কারণ হয়। লেখকের পরিচিত নির্দিষ্ট এলাকা শিল্পে চিত্রিত হতে যদি জখম বা দুর্বল হতো তার পরিণতি গিয়ে দাঁড়াত সে ফ আঞ্চলিক পাঁচালি। শহীদুল জহির নিভৃতচারী কিš' অনুসন্ধানী, কোলাহলবিমুখ কিš' প্রাণাবেগ ও জীবনের চাঞ্চল্য প্রকাশে দৃঢ় ও দক্ষ। সংঘবিচ্ছিন্ন কিš' প্রভাববি¯-ারকারীÑ ক্রমশ মনস্ক হƒদয়সংবাদী পাঠকের ধন্য লেখক হয়ে উঠছিলেন। জানা মতে, শহীদুল জহিরের সাহিত্যচর্চার সময়সীমা প্রায় ত্রিশ বছর। এই সময়ে তিনি লিখেছেন কম, পড়েছেন বেশি। খোঁজাখুঁজি করলে এমনও দেখা যেতে পারে তার অপ্রকাশিত ও অসম্পূর্ণ লেখা বাতিল কাগজের ¯-ূপে হেলাফেলায় রেখে গেছেন। নিঃশব্দে নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে তিনি প্র¯'ত করেছেন। ওই যে আপ্তবাক্য, সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বালাতে হলে দিনে সলতে পাকাতে হয়। নি¯-ারহীন অতৃপ্তি লেখককে একটি লেখা থেকে আরেকটি লেখার জন্য প্ররোচিত করে। এখানে কোন কোন লেখক ধৈর্য ও নিজস্ব অধ্যবসায় নিয়ে লেখা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করেন। একই সঙ্গে নিজের লেখার পোস্টমর্টেম করেন। শহীদুল জহির ছিলেন এমন বিরল গোত্রের লেখক। এর উদাহরণ তার 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা', 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল', 'মুখের দিকে দেখি', 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প', 'ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প' উপন্যাস, গল্পগ্রন্থসমূহ। বিষয় নির্বাচনে তিনি ব্যতিক্রম এবং সাবধানী। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে শহীদুল জহির নিশ্চিত উজ্জ্বল নাম যার পাঠ তৃষ্ণা ছিল বিশ্বব্যাপী, ভুবনডাঙ্গা থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজের সাহিত্যের স্বতন্ত্র চারা রোপণ করেছিলেন স্বভূমিতে। স্বদেশের চৌহদ্দিতে ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা মেলে নিজে হয়ে উঠেছিলেন একজন দ্যুতিময় লেখক।
শহীদুল জহির বা¯-ববাদী লেখক। তিনি লাতিন আমেরিকার জাদুবা¯-বতার ধারারও লেখক। দুইয়ের যাই হোন, কাহিনীতে জালের পর জাল সৃষ্টি করলেও, তার গণ্য অবা¯-ব, স্বপ্নালু জগৎসহ তাবৎ লেখার শেকড় বা¯-বতা ছিঁড়ে আলাদা হয়নি। চরিত্র দেখার, দেখানোর জন্য পায়ের নিচে যে ভিত রেখে তিনি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার সারাৎসার দ্বারা আলোড়িত হয়ে নিজের জন্য বিশ্লেষণ তৈরি করেন অংশত এটা মার্কসবাদের আলোয় তৈরি। অংশত মানে ধ্র"পদী মার্কসবাদের জোরালো তত্ত্বেও তিনি আবৃত বা অভিভূত নন। তার দৃষ্টিভঙ্গি বরং সফিসটিকেটেড মার্কসবাদীর। এই অভিধা তাকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না। লেখার মধ্য দিয়ে লেখক জীবনবীক্ষা ছড়িয়ে দিয়ে যান। কারও লেখায় তা প্রত্যক্ষ, কারও লেখায় তা মৃদু, থেকে যায় পরোক্ষ। মানুষ ও বা¯-বতা, বা¯-বতার আড়ালে থাকা বা¯-বতা সন্ধানে ও সন্ধানকালে শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্যের অš-ঃ¯-লে বিরাজ করে অর্থবোধক শক্তির সন্ধান। বিষয়টি মেধাবী পাঠকের জন্য অনুভবের ও বিবেচনার। ছক বাঁধা নিজস্ব আইডিয়া বা চরিত্রের তৎপরতার মধ্য দিয়ে তার দার্শনিকতা ধারণ করে বিষয় ও চরিত্র দুই-ই অযথা ভারি হয়ে যায় না। কোথাও তারা সুতোয় বাঁধা পড়েন। লেখকের প্রকাশ্য বা গোপন ইচ্ছা জিতিয়ে দেয়ার জন্য গল্প-উপন্যাসের চরিত্র পুতুল হয়ে যায় না। এ কাজটি তখুনি সম্ভব লেখক যখন পরিমিতবোধ ও নির্লিপ্তির মাত্রা যোগ্য হাতে মোকাবেলা করতে পারেন। 'পারাপার', 'ডলু নদীর হাওয়া', 'ডুমুর খেকো মানুষ' গল্পগ্রন্থ এবং 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা' উপন্যাস তার প্রমাণ। শহীদুল জহিরের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, 'আমার লেখা মার্কসবাদে আচ্ছন্ন ছিল। এখনও সেটা আছে। প্রতিবাদী ভঙ্গি থেকে আমি সরে এসেছি। ওখান থেকে সরে আসা মুশকিল।' (প্রকাশিত সাক্ষাৎকার/আরকে রনি)। না, মার্কসীয় দর্শন নিয়ে তিনি মোটা দাগের বা উচ্চকিত সাহিত্য করেননি। তার প্রতিবাদী ভঙ্গি কখনোই প্রখর, তীব্র, তীক্ষè যার একটাই অর্থ চড়া তা নয়। মার্কসীয় চিš-ার পলিশড ফরমের প্রলেপ বরং সাহিত্যে দেখা যায়। গল্পের বিষয় থেকে বিষয়াš-রে যেতে তাই সুবিধা হয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন রকম পরিণতির সম্ভাবনা তৈরি করে বলে পাঠক থেকে পাঠকে শহীদুল জহিরের লেখার অর্থ আবিষ্কার হয় বিভিন্ন। শহীদুল জহিরের 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা' উপন্যাস যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ হলেও এর সূত্রপাত ঘটে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রে রেখে। 'বদু মওলানার একাত্তরের প্রথম দিককার চেহারার টানাপোড়েন পঁচিশে মার্চের পর কেমন প্রশাš- হয়ে আসে এবং মহল্লায় যেদিন প্রথম মিলিটারি আসে সেদিন সে কিভাবে আবিষ্কৃত হয়। মহল্লার লোকেরা সেদিন মাত্র এক ঘণ্টার প্রলয়ের পর বুঝতে পারে তার বিশেষ মর্যাদার কথা।' উপন্যাসে এমন ইঙ্গিতই একজন পাকি¯-ানি দালাল চরিত্রের জন্য যথেষ্ট। বিকেলে বদু মওলানা মহল্লার আকাশে কাক ওড়াত। কাকের উদ্দেশে যে মাংসের টুকরোগুলো ছুড়ে দিত সেগুলো ছিল মানুষের মাংস। মানুষের শরীরের টুকরো টুকরো অংশের যে বর্ণনা এই উপন্যাসে শহীদুল জহির দিয়েছেন তা পড়তে গিয়ে পাঠকের øায়ু ও শিল্পের সংযম প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। আবার তিনি আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন প্রসঙ্গাš-রে সরে গিয়ে। একাত্তরের নিষ্ঠুর বা¯-বতা তুলে তিনি কি পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা করেন? একবার অতীত একবার বর্তমানÑ একই সঙ্গে উভয় সময়কে ভ্রমণ করিয়ে গেঁথে তুলেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা। আমরা নরঘাতক বদু মওলানা সম্পর্কে জানতে পারি : 'বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া বিষয়ক তার যে দুর্যোগ হয় সেই অবস্থার ভেতর দিয়ে পার করে নিয়ে আসে এবং আশি সনে সেই একই দলের বড় নেতা হয়। আবদুল মজিদ এখন দেখে আজিজ পাঠানদের সঙ্গে বদু মওলানার দল একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে।' আমরা বা¯-বেই দেখতে পাচ্ছি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যায্য একাধিক পরিবর্তনের সুযোগে যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয়েছে। আবার তারা শক্তি পেয়েছে। শহীদুল জহিরের এ উপন্যাসটি ছোট হলেও তলদেশস্পর্শী। পুরনো ঢাকার মহল্লাভিত্তিক ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ দেশের সমকালীন দুর্দশা।
মেঘহীন পূর্ণিমা রাতে সুহাসিনী গ্রামের মফিজুদ্দিন মিয়ার সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা জানিয়ে শুরু হয় শহীদুল জহিরের 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' উপন্যাস। বারবার আসে ভাদ্র মাসের অতিকায় চাঁদ, পূর্ণিমার চন্দ্রালোকিত রাত। মফিজুদ্দিন জš§গ্রহণও করে 'পূর্ণিমার চাঁদটি যখন পরিপূর্ণ অনাবৃত।' 'সুহাসিনীর লোকেরা পরে জানতে পারে যে, আকালুর বোবা স্ত্রী খুব কষ্টের পর একটি ছেলে সš-ানের জš§ দেয় এবং ছেলেটি জšে§র সেই একটি মুহূর্তে কুঁড়েঘরের দুয়ারে বসে প্রতীক্ষারত আকালু ঘরের ভেতর থেকে নবজাতকের চিৎকার শোনে এবং তখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একচিলতে জ্যোৎøা তার পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে।' উপন্যাসে অসংখ্যবার চাঁদ-জ্যোৎøা-ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার উপস্থিতি দারুণ জমাট এক রহস্য তৈরি করে। সেই রহস্যের মধ্যে মফিজুদ্দিনের উত্থান এবং 'ধ্বংস¯-ূপের ভেতর মৃতদেহের সঙ্গে তাদের স্মৃতির সম্ভাব্য সাক্ষীগুলোও' পাঠক পেতে থাকে। তোরাপ আলী এখানে কথক। তার বয়ানের মধ্য দিয়ে দীন কৃষকের ছেলে মফিজুদ্দিনের বেড়ে ওঠা। এলাকার মর্যাদাশীল মিয়াবাড়ির মেয়ে চন্দ্রাভানকে বিয়ে করা। এগারো সš-ানের পিতা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার ঘটনাবলী জানা যায়। কাহিনীর পরতে পরতে রহস্য থাকলেও তা ভেঙে আমরা জনতে পারি পাড়াগাঁর দুরবস্থা, ভাঙা-গড়া, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র, ভালোবাসা। নারী লিপ্সা ও বিরামমহীন যৌনকর্ম।শহীদুল জহির লাতিন আমেরিকার জাদুবা¯-বতার ভাবশিষ্য। গার্বিয়েল মার্কেজের উপন্যাস পড়ে তিনি আলাদা এক টেকনিকের সন্ধান পান। ওই টেকনিকে 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' রচিত। জাদুবা¯-বতা ওই মহাদেশের সাহিত্যে নতুন কোন বিষয় নয়। কথাসাহিত্যে জাদুবা¯-বতা যখন আš-র্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়, গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল পুরস্কার পান তখন এটা তুমুল আলোচিত হতে থাকে। পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকায় পৌনঃপুনিকভাবে বারো হাতে চটকানো কাহিনী নতুন আবেদন ও বিষয় ধাবণে অক্ষম হয়ে পড়ে। তাদের সাহিত্যের শূন্যগর্ভ করুণ অবস্থার কারণে সাহিত্যবোদ্ধারা মনোনিবেশ করেন লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্যে। পেছন ফিরে দেখা যায়, দেশভাগের পর ষাটের দশকে ঢাকায় যে কোন সময়ের চেয়ে ইউরোপীয় সাহিত্যের বই বেশি পাওয়া যেত। এই সাহিত্যের পঠন-অভিজ্ঞতা আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করে। কিš' কেবল পু¯-কী অনুভব দিয়ে নিজস্ব সাহিত্য রচনা করা যায় না। পরের কথা ও লিপিকৌশল নিজের মতো করে গড়ে তোলা না গেলে তা আয়ুষ্মান সাহিত্যের মর্যাদা পায় না। ষাটের দশকের সেসব কবি-সাহিত্যিকের অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। কেউ কেউ এখনও সক্রিয় থাকলেও আগের ধারা থেকে সরে এসেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আশির দশকে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের সাহিত্যের বই বেশি বেশি পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকার দেশ থেকে দেশে ভৌগোলিক- রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, বহু সীমাš- থাকলেও স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা, লোককথা, পুরাণ, কিংবদšি-, ওই মহাদেশের ঐতিহাসিক চরিত্র। বীরপুরুষরা প্রাক শিল্পায়ত দেশগুলোর জন্য এক অখণ্ড শিল্প-সাহিত্যের উপকরণ। লাতিন আমেরিকার লাইফমোটিফ নিয়ে অন্যরকম রাজনীতি নিয়ে লেখকরা সৃষ্টি করেন তথ্যময় সব উপন্যাস। জাদুবা¯-বতা প্রকৃতপক্ষে আর কঠিন এবং মাটি থেকে ছেঁকে তোলা বা¯-ব। কেবল সাহিত্য রচনার জন্য, পাঠককে মহাদেশের ভেতর কাঠামোর ভাষ্য জানানোর জন্য চাই প্রচলিত ভাষাতন্ত্রকে ভেঙে ফেলা যা শাসকদের বাসনা এবং সমাজের উপর মহলের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-বিধিনিষেধ হয়ে আছে। এমন মহৎ কর্ম মার্কেজের আগে আলেহে কার্পেšি-য়ের, আনহেল আ¯'রিয়াস, হুয়ান রুলফো'সহ অনেক সমাজলগ্ন সচেতন লেখক উপলব্ধি করেছিলেন। আমাদের সমকালীন কথাসাহিত্যে শহীদুল জহির জাদুবা¯-বতার পরিশ্রমের কাজটি করে চলেছিলেন। তার গল্প-উপন্যাস পড়ে ধারণা হয়, শহীদুল জহির বুঝি মনে করতেন, তার আখ্যানের দুর্ধর্ষ উপস্থিতিকে ফুটিয়ে তুলতে হলে আখ্যায়িকা তৈরির যে রীতিনীতি কৃৎকৌশল ভাষাব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে খাড়া করা হয়েছে তার সবকিছুকেই ভেঙে ফেলতে হবে। এ কারণে নীরবতা দিয়ে তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। শহীদুল জহির প্রচার-প্রপাগান্ডা থেকে দূর থাকলেও, আমাদের পরনির্ভরশীল আপসকামী স্টাবলিশমেন্ট তার সাহিত্যকে কদর না করলেও ধীরে ধীরে তিনি আরও পরিণত, আরও ক্ষমতাবান লেখক হয়ে উঠছিলেন। শুরুর দিকে তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন। ক্রমে ক্রমে তার লেখার ধরন, বিষয় বুননের মুগ্ধতা নিয়ে এ-কালের নবীন লেখকদের সমাবেশ দেখা যায়। অবশ্যই এটা ইতিবাচক দিক।
শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাসের বাক্য দীর্ঘ। বিষয় নির্মাণে, চরিত্র চিত্রণে, রূপকল্প সৃৃষ্টিতে তার মনোভাবনা যতক্ষণ পুরোপুরি ধরা না পড়ছে, বাক্য তিনি তৈরি করে যাচ্ছেন। এ কারণে তার গল্প-উপন্যাসের বাক্য কখনও গভীর হলেও বুনোট মোলায়েম নয়। প্রশ্ন হতে পারে, তিনি কি পাঠককে তার লেখায় প্রবেশ-পথ দিতে ইচ্ছুক নন। শহীদুল জহির উদ্যোগী নিয়ত যতœশীল পাঠকের নিñিদ্র মনোনিবেশ কামনা করেন। সময় খরচের সময় আছে এমন মজা-সন্ধানী পাঠক তার পাঠক হতে পারেন না। গভীর একাগ্রতা দিয়ে তার আখ্যানের অর্থোদ্ধার করতে হয়। এখানেই বারোয়ারি লেখকদের সঙ্গে শহীদুল জহিরের পার্থক্য। দেশের তিন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আত্তীকরণ করলেও শহীদুল জহির নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে নিষ্ঠাবান ছিলেন। তার প্রয়াস ছিল ঐতিহ্যকে খারিজ করে নয়, বরং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিত জীবনকাল নতুনভাবে নির্ণয় করা। ভুঁইফোড় সাহিত্য বলে কিছু নেই। মুক্তিপ্রয়াসী সাহিত্য প্রথাগত সাহিত্যে আস্থা না রাখলেও পূর্ববর্তী ধারাকে বাতিল করে দেয় না। রুটলেস সাহিত্য বলে যদি কিছু থাকে তবে তা খণ্ডকালীন দুরূহতা সৃষ্টি করে নিঃশেষ হতে বাধ্য। শহীদুল জহিরের টান টান গদ্য রচনায়, বিষয়ানুযায়ী ও চরিত্রানুযায়ী ডায়লগ লেখায়, গ্রামীণ পটভূমি নির্মাণে, উইট-হিউমার প্রকাশে, এমনকি স্বাভাবিক স্ল্যাং ব্যবহারে উল্লিখিত তিন জ্যেষ্ঠ লেখককে মনে করিয়ে দেয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ব্যবহার করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চরিত্রকে ঝাঁজরা করে ফেলেছেন। রূঢ় বা¯-বতা ধরতে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ ও আপসহীন। শহীদুল জহির অত নির্মম নন। বরং দয়া-মায়ার অংশে চরিত্ররা ভাগ পায়। বিষয় বদলে গেলে পরিবর্তিত ধ্যান-ধারণার জন্য নতুন কলাকৌশল বা আঙ্গিক অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। লেখকের এখানে আলাদা কসরতের প্রয়োজন পড়ে না। গল্প-উপন্যাস উত্তীর্ণ সাহিত্যের মর্যাদা পেলে কি গদ্য কি আঙ্গিক সব সফলভাবে বিরাজ করে যা শহীদুল জহিরের স্বকীয় প্রতিভাদীপ্ত কর্মের মধ্যে আমরা পেয়েছি।এই প্রথম স্বাধীনতা-উত্তর আশির দশকে আবির্ভূত ও বিকশিত একজন শক্তিমান সর্বাংশে আধুনিক কথাসাহিত্যিকের প্রকৃতই অকাল প্রয়াণ ঘটেছে।

সতীর্থপুরাণ : শহীদুল জহির


মু হ ম্ম দ স বু র

আমরা হেঁটেছি যারা পৌষের সন্ধ্যায়' তাদের একজন ছিলেন আমাদের শহীদুল হক কিংবা শহীদুল জহির। হিম হিম সন্ধ্যায় খড়ের গাঁদার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সোঁদা গন্ধের আমেজ তাকে কাবু করতো কিনা কখনো স্পষ্ট হতো না। বহুদিন, বহুরাত একই ছাদের নীচে কিংবা খোলা আকাশের নীচে মুখোমুখি বসে নির্বাক কাটিয়ে দিয়েছি যে যার ভাবনার জগতে। এ বাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে নানা ভোজে অংশ নেয়া দু'জনের মাঝে কথা হতো যেন কার্টুনের ভাষায়। সংক্ষিপ্ত শব্দ, বাক্য ব্যবহারের অনুশীলন চলতো। সেই সত্তর সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নানা সময়ে নানা আয়োজনে দেখেছি তাকে।


সেই কবে দেখেছি তাকে, বয়ঃসন্ধিকালে। কনিষ্ঠ এই আমি পেয়েছি ঠাঁই তার কাছে অনায়াসে দূরত্ব-দূর ব্যবধান সত্ত্বেও। গণঅভ্যূত্থানের সেই ঊনসত্তর সালে চট্টগ্রাম থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া শহীদুল হককে পেয়েছিলাম পরবর্তী বছর সত্তর সালে। যখন আমি প্রথম বর্ষে, তখন তিনি দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। কী সপ্রতিভ, মিষ্টিহাসি আর লাবণ্যমাখা শহীদুলের মধ্যে তখন থেকেই গুরুগম্ভীরভাব মাঝে মাঝেই ফুটে উঠতো।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের স্কুল জীবন শহীদুলের কেমন কেটেছিল জানি না। কাছাকাছি স্কুলের ছাত্র হিসেবে জানা ছিল সে সময়কাল, অস্থিরতার দিন-রাত। দেশজুড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশে। সেই সময় স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে ঢাকা কলেজে পড়ার সময়টি ছিল উত্তাল আন্দোলনের দিনরাত। সত্তর সালের আগস্ট মাসেই সম্ভবত ঃ শহীদুলের সঙ্গে পরিচয়পর্ব কলেজ ক্যান্টিনে। সহপাঠী কামাল চৌধুরীর সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলাম। একই টেবিলের একপাশে বসে সিঙ্গারা চিবুচ্ছিল শহীদুল। কথার ঢেউ তার কর্ণকুহরে অবলীলায় ঢুকে পড়ে এবং তাগাদা দেয় তাকেই পরিচয় হতে। শহীদুলই প্রশ্ন তোলেন,- অ'নেরা কি পইট্টাত্তন আইস্সনদে।
এরপর কিছু বাক্যালাপ, স্কুল জীবন কোথায় কেটেছে ইত্যাদি। এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়ে কলেজে ভর্তি হন তিনি। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে দেখা হতো, 'কেন্ আছন কিংবা উত্তর হতো গম ন'লা'র। পুরনো ঢাকায় তখন শহীদুল থাকতেন। একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন, সম্ভবত সত্তরের অক্টোবরে। ভাগ্নের জন্মদিনে সতীর্থের মধ্যে তাকেও বলেছিলাম। যথারীতি এসেছিলেন; ফ্রাঙ্কলিন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত বিশ্বের সেরা রূপকথা বই হাতে। যাবার সময় আমার সংগ্রহ থেকে নিয়েছিলেন দস্তয়ভয়স্কির ইডিয়ট উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ আর নরেন্দ্রনাথ মিত্রর উপন্যাস কাঠগোলাপের গন্ধ। ততোদিনে অসহযোগ আন্দালন শুরু। কলেজ বন্ধ। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলায় চলে গেলে শহীদুল হক বিস্মৃত হতে থাকেন আরো অনেক কিছুর মতো।



যুদ্ধপরবর্তী কলেজে ফিরে এসে শহীদুল হককে আর পাইনি। তিনি ততোদিনে কলেজ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে গেছেন। ৭৩ সালে আবার দেখা, আমিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউমার্কেটে মনিকো রেস্তোরায় হঠাৎ দেখি শহীদুলকে। সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসা সম্ভব হয়নি উভয়ের স্বভাবগত কারণেই। 'বদ্দা ক্যান আছন জানতেই গম আছি বলে সহাস্যে করমর্দন করেছিলেন। হাতে কোলকাতার মাসিক চতুরঙ্গ ছাড়াও দেখেছিলাম একটি বই। সম্ভবতঃ অমিয় ভূষণ মজুমদারের কোনো উপন্যাস। এখন মনে পড়ছে না। আলাপচারিতার প্রসঙ্গ ছিল কারা কারা যুদ্ধে গেছেন, সেসবও। তারপর মাঝে মাঝে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন কিংবা মধুর ক্যান্টিনে দেখা হয়েছে। কুশলাদি ছাড়া আলোচনা তেমন আর এগুতো না।


এইচএসসি, বিএ সম্মান এবং এমএতে ভাল রেজাল্ট ছিল। সম্ভবতঃ ৭৭ সালে ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন শহীদুল, তারপর যোগাযোগহীন। '৮১ সালে আবার দুজনে দেখা। অগ্রজ সহপাঠী এবার সতীর্থের সারিতে পড়ে গেলেন।


বিসিএস '৮১ ব্যাচের সতীর্থ শহীদুল ২২০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডার পান। ৮১ সালে ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে দেখা তার সাথে। শাহবাগের কোটায় আবাসিক প্রশিক্ষণ কালে একসঙ্গে ক্লাশ করেছি কতো সকাল-বিকেল-দুপুর, সন্ধ্যায় একসঙ্গে হেঁটেছি, রাত জেগেছি। কোর্সের বিষয়, প্রশিক্ষকদের জ্ঞানদান পদ্ধতি, চাকরি জীবনের পোস্টিং ইত্যাকার বিষয়াদি আলোচনায় এলেও সাহিত্য সচরাচর আসেনি। প্রশাসন ক্যাডারের শহীদুল আর ট্রেড ক্যাডারের এই আমি স্বল্পবাক হবার কারণে আড্ডাবাজ হবার সুযোগ কম ছিল। শাহবাগের আকাশের নক্ষত্র চিনিয়েছিল শহীদুল অনেক রাত জেগেও। গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে তার আগ্রহ অপরিসীম, মার্কসের দ্বাঞ্জিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গ মাঝে মাঝে তিনিই তুলতেন। বিশ্বজুড়ে তখন সমাজতান্ত্রিক জাগরণ তুঙ্গে। শহীদুল যে বামঁেঘষা তা ষ্পষ্টতঃই বুঝতে পারতাম। তবে সেটা যে সক্রিয় কোন সাংগঠনিক আবরণের নয়, তা-ও বোঝা যেতো।


'৮১ সালের ৩০ জানুয়ারি শহীদুল সহকারি সচিব হিসেবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও সড়ক পরিবহন বিভাগে যোগ দেন। ৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। এসময়ে আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, '৮৪ সালের মার্চে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ে যোগ দেন সহকারী সচিব পদে। ছিলেন ৮৭ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত। ৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ৯১ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্কবিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব। '৯১ সালের ১ আগস্ট থেকে ৯২ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত ওএসডি থাকার পর পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগে (১৮/৭/৯২-২৯/৯/৯৪), সিনিয়র সহকারী সচিব, ৩০/১২/৯৫ পর্যন্ত সাভার বিপিএটিসিতে অপারেটিভ বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন। এরপর যোগ দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে (২৫/৩/৯৯-১৪/৪/৯৯)। ৯৯ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ওএসডি থাকার পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপসচিব পদে যোগ দেন (১৫/৪/৯৯-৭/১১/০১)। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর যোগ দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক পদে। ছিলেন ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত।


যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০০৩ সালের ৩০ আগস্ট অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগ দেন, ছিলেন ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত। মাস খানেক ওএসডি থাকার পর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর যোগ দেন টিসিবি'র চেয়ারম্যান পদে। ৬ মাস এই পদে থাকার পর ২০০৬ সালের ৩ মার্চ বীমা অধিদপ্তরের প্রধান বীমা নিয়ন্ত্রক পদে যোগ দেন। প্রায় ৪০ দিন এই পদে ছিলেন। এরকম একটি পদ যে আছে, তা জানা ছিল না। এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি ঐ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর যোগ দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদে। ছিলেন ২০০৮ মাসের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে।
১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্ম নেয়া শহীদুল হকের চাকুরীতে যোগদান ১৯৮১ সালের ৩০ জানুয়ারি। বাবা নুরুল হক এবং মা জাহানারা বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তানটি ৯১ ও ২০০১ সাল আমেরিকা ও ব্রিটেনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পরিকল্পনা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। ফরাসি ভাষা শিখেছেন ৯০ সালে। ফরাসি সাহিত্য পাঠের জন্য সম্ভবত। সে সময় নিয়মিত অলিয়ঁ ফ্রঁসেজে যেতেন এবং ফরাসি চলচ্চিত্রও দেখতেন। এ তথ্য তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।



৯০ সালে শহীদুলের সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা গোড়ানে শ্বশুরালয়ে। ঐ দিন জানা গেল, তিনি আমার স্ত্রীর বড় বোনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শুধু নন, শ্বশুরের এলাকায় বাড়ি। সেই সুবাদে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় তাদের। ঢাকা কলেজের শহীদুল সেই থেকে আমার কাছে হয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়ীর লোক। মাঝে মাঝে আমাকে ঠাট্টা করে 'জামাই বাবাজী' সম্বোধনও করেছেন। পারিবারিক অনেক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। শ্বশুর বাড়ীতেই শহীদুল জহিরের লেখা 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' উপন্যাসটি প্রথম দেখেছিলাম। কিন্তু সেটি যে তারই লেখা, জেনেছিলাম অনেক পরে। যখন তিনি তার পারাপার গ্রন্থটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। শহীদুলের বাসায় আমাদের কখনো যাওয়া হয়নি, তিনিই এসেছেন বিভিন্ন আমন্ত্রণে। এসে চুপচাপ থাকতেন। তবে সবার কুশলাদি জানতে চাইতেন। বেশির ভাগ সময় বইপত্র নাড়াচাড়া করেই কাটাতেন।


কর্মজীবনে ৬ বছর কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় কয়েকবার ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল; হয়তো সে সময়টায় তিনি আমার শ্বশুর বাড়ীতে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বলেই। আমার শ্বশুর ৪ খানা বই লিখেছিলেন। ব্যাংকার জীবনের অবসরে সমাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। শ্বশুরের সাথে শহীদুল জহিরের সখ্যতা ছিল বলা যায়। শহীদুল হক তার লেখালেখি নিয়ে আলাপ করতে চাইতেন না। বরং অনেক সময় নতুন কিছু লিখছেন কিনা জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলতেন, এই আর কি। আমার সঙ্গে চাটগাঁর ভাষায় কথা বলাটা ছিল তার সহজাত।
হয়তো শহীদুল হক কিংবা শহীদুল জহির নেই। হয়তো আছেন, হয়তো ঘুমিয়ে আছেন, হয়তো আছেন সতীর্থ, সহকর্মী, সহমর্মী, সহযোদ্ধাদের মনে এবং দীর্ঘদিন জুড়ে থাকবেন পাঠকের মনে অন্য আলোড়নে। সতীর্থের পুরাণ কাহিনী শেষ হবার নয়। মানুষের হৃদয়ে-মননে, চিন্তায় নবজাগরণে আরো বেশি আলোড়িত হবেন শহীদুল জহির। ছিলেন যিনি আমাদের সতীর্থ।

-
-

সমকালের আড্ডায় শীর্ষেন্দু


দুই বাংলাতেই তার পাঠকপ্রিয়তা সমান। জন্মস্টÿান এবং পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি বাংলাদেশেই। ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণকারী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখালেখির বয়স ৪০ বছরেরও বেশি। কলকাতার স্টড়্গটিশ চার্চ কলেজের বাংলা সাহিত্যের স্টম্নাতক (সল্ফôান) ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শীর্ষেন্দু পেশায় সাংবাদিক। দীর্ঘকাল ধরে কর্মরত আছেন আনন্দবাজার গ্রুপের ‘দেশ’ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাসও প্রকাশিত হয় দেশ-শারদীয় সংখ্যায় (১৯৬৭)। ঘুনপোকা, মানবজমিন, পারাপার, যাও পাখি, দিন যায় প্রভৃতি উপন্যাস বাংলাসাহিত্যের পাঠকদের কাছে বিপুলভাবে নন্দিত করেছে তাকে। এছাড়া তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শ্যাওলা, লালনীল মানুষ, ফুলচোর, উজান, ক্ষয়, জাল, ফজর আলী আসছে, শিউলির গল্পব্দ, এই আমি রেনু, উজান গঙ্গা, সওয়ার, ঊনিশ শ বিশ, রক্ত মাংস নিয়ে, লক্ষ্মী পাঁচালি, বড় পাপ হে, বাসভূমি প্রভৃতি। ছোটদের জন্যও লিখেছেন অনেক। তার উল্ক্নেখযোগ্য কিশোর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- গৌড়ের কবচ, সোনার মেডেল, বিপিন বাবুর বিপদ, হারানো কাকাতুয়া, চত্রক্রপুরের চক্করে, ছায়ামুখ, গোলমাল, দুধসায়রের দ্বীপ, হরিপুরের হরেক কা,ৈ পাতাল ঘর ইত্যাদি।বয়সের ভারে এতটুকু ক্লান্স্ন নন তিনি। এখনো লিখছেন দু’হাতে। বাংলাদেশের ঈদসংখ্যাসহ বিভিল্পম্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার কাগ্ধিক্ষত লেখক তিনি। তার প্রতিটি উপন্যাস যেন জীবনের এক একটি স্টস্নরের উন্মোচন। বিষয়ের ভিল্পম্নতা আর বৈচিত্র্যে এবং গল্কপ্প বলার আশ্চর্য কুশলতায় এক জাদুকরি ভাষায় মুগ্গব্দ করেন তিনি তার পাঠকদের। চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিক থেকে কলকাতার মধ্যবিত্ত এমনকি দরিদ্র নিল্ফম্নবিত্তসহ বাংলার লোকসমাজের বহুবর্ণিল ছবি কখনো আনন্দে, কখনো দুঃখ যন্পণার ধহৃসরতায় চিত্রিত তার উপন্যাসে।সাহিত্যে অবদানের জন্য পাঠকপ্রিয়তার পাশাপাশি পেয়েছেন গুরুত্ম্বপহৃর্ণ সল্ফôাননা এবং স্ট্বীকৃতিও। তার কাহিনী নিয়ে হয়েছে চলচিত্র ও নাটক। পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের পুরস্টড়্গার। ১৯৮২ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্টড়্গার। আকাদেমি পুরস্টড়্গারের মতো মর্যাদাবান পুরস্টড়্গারেও ভূষিত তিনি।

নাসির আহমেদঃ দৈনিক সমকালে আপনাকে স্ট্বাগত জানাচ্ছি। আপনার মতো একজন পাঠকনন্দিত কথাশিল্কপ্পীকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা অত্যন্স্ন আনন্দিত। কারণ বাংলাভাষার একজন অসাধারণ লেখক আপনি। কিন্তু আমাদের খুব কৌতূহল বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস যখন পশ্চিমবঙ্গে লেখা হয় তখন প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের কথাই আলোচনায় আসে। অভিল্পম্ন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ হয়েও বাংলাদেশের সৈয়দ ওয়ালীউল্ক্নাহ বা শওকত ওসমানের মতো শক্তিমান কালজয়ী লেখক বাদ পড়ছেন- ব্যাপারটি কীভাবে দেখছেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আমার মনের মধ্যে কোনো বিভাজনই কাজ করে না। বিভাজনটি রাজনৈতিক। দুই বাংলার লেখকদের লেখা নিয়েই বাংলা সাহিত্য। কিন্তু এখানকার চ্যানেল ওখানে দেখা যায় না। এখানকার পত্রিকা ও বই ওখানে তেমন পাওয়া যায় না। যা-ও দু’একটা বই পাওয়া যায়, তাও নগণ্য। এ প্রতিবল্পব্দকতা আমাদের কাটাতে হবে, যোগাযোগের ব্যবধানটি কমিয়ে আনতে হবে। এর জন্য কার কাছে যাব, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হবে; সে উদ্যোগ আমাদেরই সল্ফিôলিতভাবে গ্রহণ করতে হবে।
নাসির আহমেদঃ কিন্তু বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা সমাদৃত, পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাগুলো বা প্রকাশকদেরও কেন বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে এত অনীহা?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আমরা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করি। বিভিল্পম্ন আড্ডায় এসব ব্যাপারে কথা হয়। প্রকাশকদের সঙ্গে যদি সঠিকভাবে যোগাযোগ এবং বই আদান-প্রদান করা যায়, তাহলে দহৃরত্ম্ব দহৃর করা যায়, আর এটা হলো বাণিজ্যিক ব্যাপার। এখানের লেখকরা তো ওখানে ওইভাবে পরিচিত নয়।
বেলাল চৌধুরীঃ এখানে আরো কিছু ব্যাপার আছে। আমাদের মুদ্রামান, আমাদের এখানে যে বই প্রকাশ হয়, এখানের সঙ্গে ওখানে অনেক তফাৎ। বুদব্দদেব বাবু একবার বলেছিলেন, ‘আপনাদের ওখানে বাংলা একাডেমী আছে, আমরাও একটি বাংলা একাডেমী করেছি, আমরা শুরু করেছি। আপনাদের বাংলা একাডেমীর বইগুলো ওখানে অন্স্নত উপস্টÿাপন করা হোক।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আমরাও কিন্তু আগ্রাসনের ভেতর আছি। আমাদের হলো হিন্দির আগ্রাসন। আসলে সরকার-সরকার আলোচনায় এসব সমাধান হতে পারে।
নাসির আহমেদঃ আপনারা আছেন দিল্ক্নির প্রবল প্রভাবের চাপে। তাই পশ্চিমবঙ্গ হিন্দি আগ্রাসনের শিকার। সেক্ষেত্রে আপনাদের লেখকদের ভূমিকা কী রকম? আমাদের এখানে তো ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, রাজপথে নেমেছি···
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আমাদের সোচ্চার হলে তো লাভ নেই। ভুল সুইচ টিপলে কাজ হবে না। এগুলো তো রাস্টস্নায় আন্দোলন করার ব্যাপার নয়। তাছাড়া আমাদের এখানে বই পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে সত্যিকার গদ্য লেখকের অভাব আছে। আমি দেশ পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে এ ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করেছি। তরুণ তুর্কিরা আসবে। সব ভেঙে দেবে। এখন তো সাহিত্যে ওখানেও সে অবস্টÿা নেই।
নাসির আহমেদঃ এ সময়ের বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যকে কীভাবে মহৃল্যায়ন করছেন?.
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ যেটুকু পড়ার সুযোগ পেয়েছি সেটুকুই পড়েছি। এখনো একটা ট্র্যাডিশনাল পর্যায় থাকলেও একটি ট্রানজিট পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য যাচ্ছে। এটা পহৃর্ববঙ্গীয় কোনো ব্যাপার নয়। এক ধরনের নিরীক্ষা। এটা আমি বলব, বাংলা গদ্যেরই একটি পর্যায়।
জুয়েল মাজহারঃ বাংলা সাহিত্য তথা বাংলাদেশের সাহিত্য ট্র্রøাডিশনাল বা নিরীক্ষাপ্রবণতার ক্ষেত্রে তাহলে আমরা কী বুঝব? তারাশগ্ধকর থেকে শুরু করে ইলিয়াস বা সৈয়দ হককে যদি আমরা একটি বড় আয়নাতে রাখি···?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ তারাশগ্ধকর তার কাজ করে চলে গেছেন। আমাদের দেশে তারাশগ্ধকরের লেখা ক’জন পড়ে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ হচ্ছে, এখনকার জীবন বদলে গেছে।
বেলাল চৌধুরীঃ এখন অবশ্য একজন লেখকের শতবর্ষ এলে তাকে নিয়ে হৈচৈ হয়। তখন সে লেখাগুলোতে আবার চোখ ফেরানো যায়।
মোজাল্ফেôল হোসেন মঞ্জুঃ আমাদের দেশে বাংলা রাষ্দ্ব্রভাষা। অথচ এখন এ-বাংলা ও-বাংলা দু’জায়গাতেই বাংলা ভাষা পিছু হটছে। ভবিষ্যৎ কী মনে করেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ কর্মক্ষেত্রে বাংলাভাষা যতটা কার্যকর কিংবা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বাংলাভাষা যতটা কার্যকর, তা আজ জরুরি বিষয়; বরং বাঙালিরা বিশেষ করে ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজি-বাংলা দু’ভাষাতেই কথা বলত। তাছাড়া আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে আছি, তারা তো অন্য প্রদেশে গেলেই অন্য ভাষায় কথা বলতে হয়। সেখানে তখন হিন্দি-ইংরেজি ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ইংরেজি শিখছি বলে বাংলা ভুলে যাব, তা হয় না। আমরা অনেক ভাষা শিখতে পারি। কিন্তু বাংলা ছাড়া যাবে না। এটাই আমার দাবি। আরো কিছু ব্যাপার আছে। কিছু লোক আছে যারা ইংরেজি শেখে বাংলা ভুলে যাওয়ার জন্য। সেই ইংরেজিও ভুলে ভরা। কিন্তু বিদেশে বাঙালিরা রীতিমতো বাণিজ্যিকভাবে বাংলা পত্রিকা বের করছে। শুদব্দ বাংলায় কথা বলছে আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে রীতিমতো বাংলাদেশ তো স্ট্বপেম্নর দেশ, এ কারণে যে, ভাষার জন্য এ দেশে রক্ত ঝরেছে। আর বাংলাদেশ রাষ্দ্ব্রটির ভাষা বাংলা।নাসির আহমেদঃ সাহিত্যে ফিরে আসি। আপনার সমসাময়িকদের সাহিত্য মহৃল্যায়ন করবেন? মুক্তিযুদব্দ-পরবর্তী মুক্তিযুদেব্দর ভিত্তিতে যে সাহিত্য ধারা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে, আপনাদের তা প্রভাবিত করেছে কি? কেন করলো না?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আমার সমসাময়িকরা এখনো লিখছেন। তাদের আমি কীভাবে মহৃল্যায়ন করব? মুক্তিযুদব্দ তো একটি স্টÿানের ব্যাপার। কোনো একটি বিশেষ প্রসঙ্গ, সেটা এ দেশের পাঠকরা যেভাবে অনুধাবন করবে, সেভাবে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা অনুভব করবে না।
মোজাল্ফেôল হোসেন মঞ্জুঃ আমাদের এখানে যে সাহিত্যের চর্চা হয়, তা আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে কি?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আপনাদের এখানকার বইপত্র, লেখা খুব একটা তো পৌঁছায় না ওখানে। যাদের লেখা পৌঁছেছে, তাদের পাঠক আছে। এ অবস্টÿা দহৃর হওয়া দরকার। সাহিত্য এবং ধর্ম নিয়েও আজকাল নানা কথা ওঠে। এক সময় চীন এবং রাশিয়ায় প্রচারধর্মী সাহিত্যের সৃষ্দ্বি হয়েছিল। কিন্তু এখন একইভাবে যদি কোনো বিশ্বাস, ধর্ম বা নীতি প্রচার করে সাহিত্য করা হয়, তা তো সাহিত্য নয়। যদি কাঁচা গোবরের গল্পব্দ না থাকে, তাহলে তা তো সাহিত্য হয়ে উঠবে না। এটা ঠিক নয়। আমি আসলে কীভাবে ব্যাপারগুলো সল্পব্দান করছি, আমার কাজে তা লক্ষ্য করতে হবে। প্রচারধর্মী সাহিত্য কোনো সাহিত্য নয়।
আবু সাঈদ খানঃ আপনি তো মার্কসীয় দর্শন চর্চা করেছেন, সেই আপনিই ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ভক্ত, ব্যাপারটা কীভাবে মেলাবেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আপনি যদি আমাকে মার্কসবাদ সর্কে জিজ্ঞেস করেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে আমি মার্কস দ্বারা আত্রক্রান্স্ন হই। তার মানে এই নয় যে, আমার পুরো জীবন মার্কসীয়। আমার যখন আটাশ বছর বয়স তখন ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সাল্পিম্নধ্যে আসি। আমি যখন বগ্ধিকমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তখন তাদের দ্বারা আত্রক্রান্স্ন হই। কিন্তু এসব ব্যাপারের মধ্য দিয়ে গেলেও জীবন, দারিদ্র্য, সংগ্রামের কথা ও মুক্তি খোঁজার কথা হয়, সেক্ষেত্রে তা যদি কোনো দর্শন নিন্দিতভাবে উপস্টÿাপন হয়, তাহলে দেখার বিষয়। বড় কথা সাহিত্যবোধ সে কাজে বিকশিত হয়েছে কি-না।
আবু সাঈদ খানঃ ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সংর্শে এলেন। এখনো ওই ধারাতেই আছেন। এ ব্যাপারে কিছু বলেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আমার তো কোনো সমস্যা হয় না। আর সমস্যা হলে তো ছেড়েই দিতাম। ঠাকুরের ভাবধারা তা ইতিবাচক ভাবধারা।
আবু সাঈদ খানঃ বাংলা বানানের ক্ষেত্রে দুই দেশেই বিভিল্পম্ন পত্রিকা বিভিল্পম্ন বানানরীতি ব্যবহার করছে। কিংবা বাংলা সনের ক্ষেত্রেও পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশের যে পার্থক্য, একই ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও এটা কেন হবে? এ ব্যাপারে আপনার চিন্স্নাভাবনা জানতে চাচ্ছি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রে এ ভিল্পম্নতা থাকা উচিত নয়। আমাদের ওখানে প্রাচীন পঞ্জিকার কারণে এসব সমস্যার সৃষ্দ্বি হয়। সেক্ষেত্রে পঞ্জিকার সংস্টড়্গার করা উচিত। বানান বা ভাষারীতি ক্ষেত্রে, ভিল্পম্নতার ক্ষেত্রে সাংস্টড়্গৃতিক হেজিমনি থেকে এটা হচ্ছে। আমি যা বলব, যা করব তাই ঠিক- ব্যাপারটি যেন অনেকটাই এ রকম।
অশোক দাশগুপ্টস্নঃ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত লেখকরা এখানকার প্রতিষ্ঠিত দু’একজন লেখকের নামই জানে। এখানকার লেখকদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও অনীহা। ওখানে এক ধরনের একমুখী বাণিজ্যিকীকরণ, যেহেতু রাষ্দ্ব্রিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যে আচরণ তাতে দুই বাংলার সাহিত্যের মেলবল্পব্দনের ক্ষেত্রে অন্স্নরায়। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে বাংলাদেশের অজস্র লেখা ছাপা হচ্ছে···।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র এখন বদলে গেছে। এখানে আমার ঈদসংখ্যার লেখা ছাপা হলে বাংলাদেশি লেখকদের লেখা ছাপার সুযোগ হয়; কিন্তু নিরীক্ষার ছাপ না থাকলে সে লেখা পড়ে কী লাভ?
আবু সাঈদ খানঃ ১০ বছর পর বাংলাদেশে এলেন? কী পার্থক্য চোখে পড়ল?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ চারদিকে দালান উঠছে। গাছপালা কমে গেছে- বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের উত্তাপ তো ভোলার নয়। এ ক’দিনের ব্যবধানে ব্যাপক কোনো পরিবর্তন আমার চোখে পড়েনি, বাংলাদেশ হলো আবেগের দেশ।
জুয়েল মাজহারঃ আপনাদের কথার সহৃত্র ধরে বলি। পত্রিকা বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সাহিত্যকে লালন করতে পারে। অথবা সাহিত্যকে অস্ট্বীকার করলে করতে পারে। এ রকম ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখছেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ প্রতিষ্ঠানের চরিত্র এ রকমই। এর সমাধান আমাদের হাতে নেই। প্রতিষ্ঠান হয়তো নিজেই লেখক নির্বাচন করে। আর প্রতিষ্ঠান লেখককে আটকে রাখতে পারে। তবে তাকে কোনোভাবেই দমন করতে পারে না। তারপরও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তো থাকেই। আমার ক্ষেত্রে বলা যায়, আনন্দবাজার আমাকে যথেষ্দ্ব আনুকূল্য না দিলে এমন হতো না। আমি যেহেতু এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, তাই বলতে পারি আনন্দবাজার নতুন লেখকের লেখা ছাপাসহ তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্দ্বা করে থাকে।
নাসির আহমেদঃ একইসঙ্গে পাকিস্টস্নান-ভারত স্ট্বাধীন হয়েছে। পাকিস্টস্নান এবং বাংলাদেশে বহুবার সামরিক শাসনে চলেছে। কিন্তু ভারতে গণতন্পের বিকাশ হয়েছে। এ ব্যাপারটি কীভাবে দেখছেন?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ আপনারা যা ভাবছেন আমিও তাই ভাবছি। আমার মনে হয়, সামরিক শাসন জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়। গণতন্পই হলো ঠিক কথা। বরং আমি বলতে চাই, ই ইউর মতো সার্ক অঞ্চলে পাসপোর্ট ও ভিসা তুলে দিন। একই রকম টাকা চালু হোক।
আবু সাঈদ খানঃ সমকাল পরিবারে আসার জন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ ধন্যবাদ।

Friday, April 4, 2008

শহীদুল জহিরের গল্প



____


৭২ বছর বয়সে তরুণদের লেখা আর পড়া হয় না তেমন। উপায় নেই। তবু বছর কয়েক আগে তরুণদের কিছু গল্প-উপন্যাস পড়তে হয়েছিল। এদের কারো কারো নতুনত্ব আছে। একটি বিষয় লক্ষ্য করে অবাকই হয়েছিলাম, এদের অনেকেই সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতায় পুষ্ট ও বর্ধিত হচ্ছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে যার লেখা আমাকে বিষ্মিত ও আশান্বিত করেছিল তিনি হচ্ছেন শহীদুল জহির। এতেও একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম, আমাদের সমসাময়িক বন্ধু প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং অন্য বহু গুণে গুণান্বিত হায়াৎ মামুদও শহীদুল জহিরের লেখা পছন্দ করেছিলেন। যে বইটি আমাদের দু'জনেরই পরস্পরের অজ্ঞাতসারে ভালো লেগেছিল, সেটি হচ্ছে শহীদুল জহিরের গল্পগ্রন্থ 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প'।

শহীদুল জহিরের প্রশংসা শুনি কিন্তু এর বেশ আগে। শিল্পতরু থেকে আবিদ আজাদ প্রকাশ করেছিল তার উপন্যাস 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল'। শিল্পতরু পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলাম আমি। কিন্তু ওই বই যখন বেরোয় তখন আমি ওই পত্রিকা থেকে সরে এসেছি, যদিও নাম ছাপা হয়ে যাচ্ছিল। প্রাবন্ধিক-সমালোচক-শিশুসাহিত্যিক আহমাদ মাযহারদের মুখে ওই বইটির সুনাম শুনতাম। কিন্তু একই সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর ধারাবাহিকতার কথাও শোনা যেত। 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' নামটিও সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর স্মারক। সে জন্য আমি বইটি পড়ার খুব একটা চাড় বোধ করিনি। কিন্তু 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' পড়ে মনে হয়েছিল, ওয়ালীঊল্লাহ প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে উপস্থিতি সত্ত্বেও শহীদুল জহির নতুন কিছু করেছেন। এখানেই তার স্বকীয় কৃতিত্ব।

সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ খুব বেশি গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখেননি। আমাদের তদানীন্তন কথাশিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী। তার ধারাবাহিকতা অংশত সৈয়দ শামসুল হকে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে, শহীদুল জহিরে এবং তরুণ কথাশিল্পীদের মধ্য দিয়ে চলেছে। সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর গল্প-উপন্যাস-নাটকের তিলতম প্রভাব নেই পশ্চিমবাংলার কথাসাহিত্যে। পশ্চিমবাংলায় তার বইপত্র কিছু প্রকাশিত হলেও তিনি তেমনভাবে স্বীকৃত বা প্রচারিত হননি। অথচ তার উত্থান ও বিকাশ কিন্তু পশ্চিমবাংলাতেই। আমি তার সমসাময়িক কথাশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে একবার কলকাতায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওয়ালীঊল্লাহর লেখা তিনি পড়েছেন কি-না। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী তার নামই শোনেননি মনে হয়েছিল। কলকাতাতেই দেখেছিলাম সুগভীর প্রাবন্ধিক-সমালোচক দেবীপদ ভট্টাচার্যের অগাধ শ্রব্দা সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর প্রতি। একবার তিনি ট্যাক্সিতে বাসায় ফিরতে ফিরতে সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের নামটির অসামান্য একটি দীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছিলেন আমার কাছে। তিনি তখন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ওই বিবেচনা লেখার সময় ছিল না তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার দেবীপদ ভট্টাচার্য ওয়ালীঊল্লাহ সম্পর্কে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় তা মুদ্রিত হয়েছিল। দেবী বাবুর অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমি প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করি শিল্পতরু পত্রিকায়।

ওয়ালীঊল্লাহ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ আমি রচনা করি, 'সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ' (১৯৮৬/২০০১)। সেই অধিকারে, আশা করি এ কথা বললে অপরাধ হবে না যে, সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ ছিলেন না সমরেশ বসু। কেন একথা লিখলাম, সেটা পরে বলছি।
তখন আমার সামনে শহীদুল জহিরের দুটি গল্পগ্রন্থ 'শহীদুল জহির নির্বাচিত গল্প' (২০০৬) এবং 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' (২০০৪)। এ দুটি গল্পগ্রন্থে গল্পের সংখ্যা মাত্র ২০টি। তার মধ্যে 'আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস' দুটি গ্রন্থেই আছে কাজেই এটি জমবে আরো। 'চতুর্থ মাত্রা' গল্পটিও আসলে গল্প নয় একাঙ্ক নাটক। আবার ওয়ালীঊল্লাহ স্মরণীয়। ওয়ালীঊল্লাহ কিছু একাগ্ধক নাটক লিখেন। গল্প ও একাগ্ধক নাটক সহবাসী। এক সময় গল্পকাররা একাঙ্ক নাটকও লিখতেন। অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, বনফুল, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহ, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ চমৎকার সব একাঙ্ক নাটক লিখেছেন। আকাশ-সংস্কৃতির পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে এ চমৎকার সাহিত্য মাধ্যমটি লুপ্তপ্রায়। শহীদুল জহিরের আরো গল্প থাকতে পারে। আপাতত এ ১৮টি গল্পই পাচ্ছি।

দুটি বই, কিন্তু আসলে শহীদুল জহিরের তিনটি গল্পগ্রন্থ : 'পারাপার', 'ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প'। এই দুটি বই নিয়ে 'শহীদুল জহিরের নির্বাচিত গল্প' বইটি সংকলিত হয় আর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ 'ডলু নদীর হাওয়া...'।

দেখা যাচ্ছে : শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক; দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের রচনাকাল ওই শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক আর তৃতীয় গল্পগ্রন্থের রচনাকাল (একটি গল্প বাদে) একবিংশ শতাব্দীর প্রথম/শুন্য দশক।

শহীদুল জহিরের জীবৎকাল ১৯৫৩-২০০৮। বয়সের হিসেবে, লেখার হিসেবেও, তিনি সত্তরের দশকের। কিন্তু তার পরিচিতি ঘটে বেশ পরে। আদি গল্প রচনার কাল ১৯৭৪ এবং অন্তিম গল্প রচনার কাল ২০০৩। এই তিরিশ বছরে ব্যাপ্ত ১৮টি গল্পে তিনি কত পরিণত হয়েছেন সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ১৯৭৪ সালে রচিত 'ভালোবাসা' এবং ২০০৩ সালে প্রণীত 'ডলু নদীর হাওয়া'র মধ্যে অনেক ব্যবধান। আবার তার তাবৎ গল্প থেকে শহীদুল জহিরের একটি চারিত্রই উদ্ভাসিত হয় সমাজের অন্তবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রনই তার লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তলোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশ, শুধু ঢাকা শহর নয় ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।

'ভালোবাসা' এবং 'ডলু নদীর হাওয়া' গল্প দুটির অতি সংক্ষিপ্ত একটি বিচার এখানে উপস্থাপন করা যাক।

তার প্রথম গল্কেপ্পই ছোটগল্কেপ্পর লিখনকুশলতা তার সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত। 'ভালোবাসা' গল্পের সূচনা বিন্দু 'বাবুপুরা বস্তির গলির মুখে আসতেই মওলার চোখে পড়ে গেল হাফিজদ্দি।/কি করে হাফিজদ্দি, ওইটা কইথন আনলি? চিৎকার করল মওলা' থেকে গল্পের উপাত্ত বাক্য 'উবু হয়ে আসা আবেদার ঠোঁট তহুরার কপাল ছোঁয়' পর্যন্ত একেবারে টান-করে-বাঁধা। মাত্র ৫ পৃষ্ঠা গল্প, কিন্তু অন্তর্গত ব্যাপ্তি অনেক। হাফিজদ্দি, তার স্ত্রী আবেদা ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে, আর ওদের কন্যা তহুরা এই তিনজনকে ঘিরে গল্পটি আবর্তিত। মওলা ওদের বস্তির পান-সিগারেটের দোকানদার, চেনা প্রতিবেশী। যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল হাফিজদ্দি, সেটা বস্তিতে কেউ আনে না, একটা একান্ত হলদে রঙের ডালিয়া ফুল। এই ডালিয়া ফুলটাই গল্পের কেন্দ্র। ওদের দারিদ্র্যমথিত জীবনে এক বিষ্ময়ের মতো উদিত হয়। বর্ণনা অল্প, কিন্তু লক্ষ্যভেদি। বাস্তবতার চিত্রণ : 'তাড়াতাড়ি পানি ঢালা ভিজা চুলগুলো ও খোঁপায় গুছিয়ে ফেলল। আঁশের মতো পাতলা আর রুক্ষ চুলগুলোর কথা ভেবে ওর (আবেদার) মন খারাপ হয়। যে ছিরি চুলের, এই চুলে কি ফুল মানায়?' কিংবা 'ভেজা শাড়ি দিয়ে চুল মোছে (আবেদা)। ধনুকের ছিলার মতো করে নিয়ে চুল ঝাড়ে চটাস চটাস শব্দ করে। বিন্দু বিন্দু জলকণা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।' অথবা 'রাতের খাবার ডাল আর রুটি। ডাল নামিয়ে রুটি সেঁকতে সেঁকতে আঁধার নামে।' লুকিয়ে ডালিয়া ফুলটা খোঁপায় পরার চেষ্টা করেছিল আবেদা, কিন্তু চুল পাতলা হয়ে যাওয়ায় পরতে পারেনি। সেটা বুকে ফ্যালে হাফিজদ্দি। স্বভাবসুলভ ক্রুব্ধ উক্তির পরেও 'হঠাৎ হাফিজদ্দি বলে, ফুলটা তরে দিয়া দিলাম যা।' আর তার ফলেই এরকম উপমা রচিত হয় : 'হঠাৎ-ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কি আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।' এরই পরিণতি গল্পের শেষ বাক্যটিতে আবেদার সন্তানের প্রতি মমতা প্রকাশে। একটি ডালিয়া ফুল বস্তির এই দরিদ্র পরিবারটিকে করে তোলে এক আনন্দিত সংসার। কিন্তু বাস্তবতা এক ফোঁটা টাল খায় না। এমনকি স্বগতোক্তিতেও উপভাষার প্রয়োগ পুরো বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত করে তোলে : 'আবেদা বলে উঠতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে। তহুরাটাকে পেটাতে ইচ্ছা করে ওর। হারামজাদি, একটা কথা প্যাটে থাকে না।'

গ্রন্থধৃত সর্বশেষ গল্প 'ডলু নদীর হাওয়া' ২০০৩ সালে রচিত। প্রথম গল্পের ৩০ বছর পর লেখা এ গল্পে দেখা যাবে শহীদুল জহিরের গল্প বুননের দক্ষতা তো অটুট আছেই, উপরন্তু তার বিষয় ও বিন্যাস হয়ে উঠেছে জটিল ও রহস্য গাঢ়। এ গল্পও বাস্তবকে পরিপূর্ণ স্পর্শ করে আছে, প্রথম গল্পটি ঢাকার পটভূমিকায় রচিত, শেষ গল্পের পটভূমি চট্টগ্রাম। স্থানিক, বর্ণনাত্মক ও উপভাষা গল্পটিকে জীবন্ত জাগ্রত করেছে। যে প্রাথমিক অভিজ্ঞান গল্প লেখকের জন্য আবশ্যিক, তার কোনো ব্যত্যয় নেই দুটি গল্কেপ্পই। 'ডলু নদীর হাওয়া' গল্পের কেন্দ্র চরিত্র দু'জন : আহম্মদ তৈমুর আলী চৌধুরী আর তার স্ত্রী সমর্ত বেগম, যে আসলে মগ মেয়ে, যার আসল নাম এলাচিং। ১৭ পৃষ্ঠার এ গল্পে আরো অনেক চরিত্র : তৈমুরের মাতা গোলেননূর বেগম, এলচিঙের প্রেমিক সুরুত জামাল, কবিরাজ শ্যামাপদ, স্বর্ণ ব্যবসায়ী জ্যোতিভূষণ দাস, তৈমুর ও সমর্তের কনিষ্ঠতম পুত্র মিরাজ আলী চৌধুরী প্রমুখ। পুরো গল্পটি একটি রাহসিকতায় আবর্তিত। প্রথম গল্পের সারল্য আর অবশিষ্ট নেই এখন। গল্পের অন্তর্বিষয়ে এবং লেখকের বর্ণনায়ও একটি জটিলতা দেখা দিয়েছে পরষ্পরে আলিঙ্গিত। গল্পের আরম্ভ বাক্য : 'ডলু নদীতে এখন অনেক পানি অথবা হয়তো পানি তেমন নাই' এরকম কূটাভাষিকতায়। পুরো গল্পের 'অথবা/হয়তো/কিংবা/বা' ইত্যাদি শব্দের পৌনঃপুনিক প্রয়োগে রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে আরো। শহীদুল কৃতিত্ব বাস্তবতা কোথাও হারায় না : উপভাষা প্রয়োগে, স্থানিকতার সমর্থ ব্যবহারে, চরিত্রায়নে।

এই রাহসিকতার বা অন্তর্যাত্রার সম্মোহ যে সব সময় সুফল বয়ে এনেছে, তা নয়। 'কাঠুরে ও দাঁড় কাক' গল্পের সূচনা বাক্যাংশ 'ঢাকা শহরের প্রবীণ অধিবাসীরা স্মরণ করতে পারে যে, বহু দিন পূর্বে ঢাকা শহর একবার কাকশুন্য হয়ে পড়ে' প্রথমেই যে রকম বানানো তেমনি গল্পের কেন্দ্র চরিত্র কাঠুরে আকালু ও তার স্ত্রী টেপিকে নিয়ে যে রূপকথা ফাঁদেন, তা রূপকথাই থেকে যায়, তার ভিতরার্থ বড় বেশি আরোপিত মনে হয়। বাস্তব জ্ঞান শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে লাগে না।

তারপরও শহীদুল জহিরকে শেষ পর্যন্ত সফল গল্পকারই বলব। এরকম শক্তিশালী একজন গল্পকারের অকাল প্রয়াণ আমাদের সামগ্রিক সাহিত্যের সস্তা চটুল প্রচারপ্রবণ আবহে সমূহ ক্ষতিই ডেকে আনল বলে মনে হয়। তার প্রশংসা করা এ জন্যও যে, তার 'বক্তব্য' তিনি পেশ করেছেন নিরুচ্চারে যা স্লোগানধর্মিতার অবসান মানে না, যা ছিল সৈয়দ ওয়ালীঊল্লাহর মধ্যেও। স্লোগানধর্মিতা আমাদের অনেক সম্ভবনাশীল ছোট গল্পকে, অনেক খ্যাতনামাকেও, শেষ পর্যন্ত বিনষ্ট করেছে।

বিজুর (পাঠক সমাবেশ) কাছে শহীদুল জহিরের ছায়া ঢাকা ব্যক্তি জীবনের কিছু ইতিবৃত্ত জানা গেল : অকৃতদার, অসম্ভব সৎ, সৎকর্মনিষ্ঠ, আত্মবৃত একজন মানুষ। আমাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কোলাহলের বাইরে থেকে, তিনি, মনে হয় আজ ভালোই করেছেন। লিখতেন গোপনে, নির্জনে। যদি অসামাজিক না হতেন তাহলেও কি কিছু গল্পের উপচার পেতেন না? কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল যে-জীবনের রূপদানের, সে বিষয়ে তন্নিষ্ট ছিলেন সেও বলতেই হবে এবং যার যার পথ তার নিজস্ব।




অপ্রকাশিত আড্ডার খসড়া

আকস্টিôক হৃদরোগে আত্রক্রান্স্ন হয়ে ২৩ মার্চ প্রয়াত হয়েছেন শক্তিমান কথাশিল্কপ্পী শহীদুল জহির। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্পণালয়ের ভারপ্রাপ্টস্ন সচিব ছিলেন তিনি। কিন্তু যত বড় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন তিনি, তার চেয়ে অনেক বড় ছিল তার শিল্কপ্পীসত্তা। অত্যন্স্ন নিরীক্ষাপ্রবণ উচ্চমানের কথাকার শহীদুল জহির তার নিভৃতচারী স্ট্বভাবের কারণে হোক আর প্রচারবিমুখ থাকার কারণেই হোক কাজের তুলনায় সাধারণ পাঠকমহলে কম পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সিরিয়াস পাঠকরা অত্যন্স্ন অনুরাগী ছিলেন তার লেখার। অপেক্ষকৃত তরুণ লেখক রেজাউল করিম নিভৃতচারী এ লেখকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আড্ডাও দিতেন। এটিই রেজাউল করিমের সঙ্গে শহীদুল জহিরের শেষ আড্ডা। এই আড্ডায় শহীদুল জহির তার উপন্যাস (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা ১৯৮৮, সে রাতে পহৃর্ণিমা ছিল ১৯৯৫, মুখের দিকে দেখি ২০০৬) নিয়ে কথা বলেছেন। প্রথম এবং শেষবারের মতো তার নিজস্ট্ব পঠনরুচি নিয়েও কথা বলেছেন। কথা বলেছেন তার উত্তর প্রজন্মের লেখকদের লেখা নিয়ে। রেজাউল করিমের সঙ্গে এ আলাপচারিতার এই নির্বাচিত অংশটুকু থেকে তার সাহিত্য প্রসঙ্গে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন পাঠক


রেজাউল করিমঃ আপনার উপন্যাস 'সে রাতে পহৃর্ণিমা ছিল'তে যে আকালুকে পাই, 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক' গল্কেপ্পও কিন্তু তাকেই দেখি?
শহীদুল জহিরঃ হ্যাঁ, একই। কারণ আপনি যখন ছবি দেখতে যান তখন একই লোক বিভিল্পম্ন চরিত্রে অভিনয় করে। যেমন ফেরদৌস ও রিয়াজ একই লোক বিভিল্পম্ন চরিত্রে অভিনয় করে। আপনি তাকে ওই বিভিল্পম্ন চরিত্রেই গ্রহণ করেন।


রে· ক·ঃ এ দুটি কি মেলাবেন?
শ· জঃ না মেলাব না। কিন্তু যাদের জন্য তাদের উপস্টÿাপন করেন আপনারা তারা নিজের বুদিব্দ প্রয়োগ করে ঠিকমতোই গ্রহণ করেন। তো এটা দুই আকার হতো পারে, কিন্তু ভাব এক, এটা পাঠক বুঝতে পারেন।তারপরও কোনো নাম দেখলে পরে আমি তালিকা রাখি। আমি নাম নির্ণয় করতে পারি না। এজন্য অনেক সময় পত্রিকায় নাম দেখলে আমার পছন্দ হলে পরে নলেজে রাখি। যেমন কিছু মহিলার নাম আমি পত্রিকা থেকে পেয়েছি। নিমফল দাসী নামটি পত্রিকা থেকে পাওয়া। খইমনও পত্রিকা থেকে পাওয়া।


রে· ক·ঃ এ নামগুলো গ্রাম-গঞ্জের কমন নাম?
শ· জঃ খইমন আমার 'মুখের দিকে দেখি' উপন্যাসের একটি চরিত্রের নাম। এটা যশোর অঞ্চলের কোনো এক মহিলার নাম পত্রিকায় এসেছিল। খইমন আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। এত চমৎকার নাম।


রে· ক·ঃ আপনি সিরাজগঞ্জের পটভূমিতে কিছু গল্কপ্প লিখেছেন।
শ· জঃ সিরাজগঞ্জে আমি থাকিনি। সিরাজগঞ্জ আমার দেশের বাড়ি। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে।


রে· ক·ঃ 'সে রাতে পহৃর্ণিমা ছিল' ১৫৮ পৃষ্ঠা একটানে লেখা, কোনো পর্ব নেই, যদিও প্যারা আছে? আপনি কোনো উপন্যাসেই পর্ব ভাগ করেননি বা পর্বের টাইটেল দেননি।
শ· জঃ 'সে রাতে পহৃর্ণিমা ছিল' আমি প্রথমে টাইটেল দিয়ে লিখছিলাম। লেখার কারণ ছিল আমি নিজেই ধরতে পারছিলাম না কোথায় কী লিখছি। যেমন রাস্টস্না নিয়ে একটা গল্কপ্প আছে। রাস্টস্নাটা তিন, চার, পাঁচ জায়গায় ফিরে ফিরে আসে। তো আমি তার সহৃত্রটা রাখার জন্য উপন্যাসের খwৈংশের হেডিং দিয়েছিলাম। যাতে আমি দ্রুত ধরতে পারি যে, কয় জায়গায় আছে এটা। একটা শিরোনাম ছিল রায়গঞ্জ থেকে আসা রাস্টস্না- এ শিরোনাম পাঁচ জায়গায় ছিল। এ রকম দুলালি নিয়ে পাঁচটা শিরোনাম ছিল। এভাবে অনেকগুলো শিরোনাম ছিল এবং ঘুরে-ফিরেই শিরোনামগুলো আসছে। তো আমি এটা ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। পরে আমার এই লেখাটা আমি একজনকে দিয়েছিলাম একটা সাহিত্য সাময়িকীতে।


রে· ক·ঃ জেমস জয়েসের একটা উপন্যাস আছে, যা দুর্বোধ্য। তো জয়েসও অনেকটা আপনার মতো বলেছিলেন, পাঠকও একটু কষ্দ্ব করুক।
শ· জঃ ওটা হচ্ছে ইউলিসিস, সল্ফ্‌ভবত আমি সিওর না।


রে· ক·ঃ না ইউলিসিসের পরেরটা, নামটা ভুলে গেলাম।শ· জঃ হ্যাঁ, ইউলিসিসের পরেরটা, ওটা ইউলিসিসের চেয়েও কঠিন।
রে· ক·ঃ 'সে রাতে পহৃর্ণিমা ছিল' একটা সফল জাদুবাস্টস্নব উপন্যাস। কিন্তু 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা'কে জাদুবাস্টস্নব উপন্যাস বলা যায় না। এখানে জীবনের বাস্টস্নবতা আসলে বাস্টস্নবতাই।শ· জঃ এজন্যই উপন্যাসের নাম 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা'। আমার ভয় ছিল পাঠক এটা বুঝবে কি বুঝবে না। এটা অনেক সময় লেখক হিসেবে আমার ভয় থাকে।


রে· ক·ঃ কিন্তু 'সে রাতে পহৃর্ণিমা ছিল'-এ অনেক অলৌকিক ঘটনা আছে, যেমন চন্দ্রভানের উলঙ্গ হয়ে নিশি রাতে গোসল করা ইত্যাদি।
শ· জঃ হ্যাঁ, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমিও সেটা মনে করি, জাদুবাস্টস্নবতা কিন্তু রূপকথা না। এটার পার্থক্য আছে। তো এটা হচ্ছে অতিবাস্টস্নব। যেমন- আপনি যদি চুলার ভেতর থেকে কৈ মাছ ধরে খান এবং এটা লেখেন। এটা আমরা করি না। কিন্তু এটা ঘটতে পারে। বন্যার পানি যদি আমার চুলার ভেতর ঢোকে তো কৈ মাছ আমি চুলার ভেতর থেকে ধরতেই পারি। সেটা সল্ফ্‌ভব। তো চন্দ্রভানের যে ব্যাপারটা, এটা কিন্তু রোগ আছে। স্ট্নিপ ওয়ার্কিং- একটা রোগ। এটা একটা মানসিক রোগ। এটা সংশোধনযোগ্য।


রে· ক·ঃ আপনার সর্বশেষ উপন্যাস 'মুখের দিকে দেখি' এখানে দরিদ্র মায়ের আদরের ছেলে চান মিয়ার কি শিক্ষিকার প্রতি প্রেম ছিল?
শ· জঃ এটা বালকের প্রেম যেমন হয় আরকি। যেটাকে আমরা প্রেম মনে করি, এটা সে রকম না। তবে এটা অবশ্যই প্রেম। বালক বয়সে শিক্ষার প্রতি যখন ভালোবাসা থাকে, সেটাও ভালোবাসা অবশ্যই।


রে· ক·ঃ এ উপন্যাস যখন পত্রিকায় পড়ি আমার অপহৃর্ণ মনে হয়েছে।
শ· জঃ বইয়ে অনেক বেশি। পত্রিকায় অনেক কম ছাপা হয়েছে।


রে· ক·ঃ আপনার এ উপন্যাসের ভাষা কিন্তু আগের দুটি উপন্যাসের চেয়ে একটু সরল।
শ· জ·ঃ হ্যাঁ, একটু সহজ। কারণ এখানে সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে। সংলাপ পাঠককে শ্বাস নেওয়ার সময় দেয়। কিন্তু ওই দুইটায় আমি সেটা দেইনি। সংলাপ থাকলেও সেখানে টেক্সটের ভেতরে গেছে। এবং পাঠক কিন্তু সংলাপ পড়তে পছন্দ করে- এটা আমি নিজেও পাঠক হিসেবে জানি। অনেক মহিলা আছে টেক্সট পড়ে না, শুধু সংলাপ পড়ে। এবং দ্রুত বই শেষ করে ফালায়। নায়ক-নায়িকা কী বলছে, সেই সংলাপ পইড়া বই শেষ করে। আগের দুটি তো পাঠকের সংলাপ পড়ার কোনো সুযোগই দেইনি। অনেক পাঠককে বহু কষ্দ্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু 'মুখের দিকে দেখি- এখানে একটু রিলাক্স আছে।


রে· ক·ঃ একজন পাঠক শহীদুল জহিরকে যদি জানতে চাই?
শ· জ·ঃ এখন পড়া কম হয়। নানা রকম উৎপীড়ন হয় জীবনে।


রে· ক·ঃ ওই বাংলার লেখা পড়েন?
শ· জ·ঃ কিছু কিছু পড়ি। ওই বাংলার লেখাকে যে বিরাটভাবে পড়া আছে, তা না। আমি বলেছি, পার্টিকুলারলি আমরা যে সময় পাগলের মতো বই পড়তাম, সে সময় এত বই পাওয়া যেত না। আমরা হাবিজাবি বই পড়ছি অনেক, যেগুলো অপ্রয়োজনীয়। সময় মানুষের সীমিত এবং বেছে বেছেই বই পড়ে মানুষ, সেজন্য কিছু রেফারেন্স পাঠ লাগে।



রে· ক·ঃ আবুল বাশার কি পড়েছেন?
শ· জ·ঃ 'ফুলবউ' পড়ছিলাম, যখন পহৃজা সংখ্যায় বেরিয়েছিল তখন। পড়ে আর পড়া হয়নি।


রে· ক·ঃ ওই বাংলার অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক আবুল বাশার।
শ· জ·ঃ হতে পারে। 'ফুলবউ' পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, সাবজেক্ট এমন একটি বিষয়কে নিয়ে- মুসলমান যদি হয় তাহলে পরে একটি সমস্যা যাচ্ছে, যাবেই তো ধর্মের সর্কে অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ধর্মের বিষয়গুলো পক্ষের কিছু লোক বিত্রিক্র করে। সেটা আপনি বায়তুল মোকাররম গেলেই পাবেন। কিন্তু অন্যের পক্ষেও এটা কিছু কিছু সেলঅ্যাবেল হয়। এবং পৃথিবীতে এগুলো বিত্রিক্র হচ্ছে।


রে· ক·ঃ আবুল বাশার কে এমনটি বলা যায়?
শ· জ·ঃ আপনার অল্কপ্প বয়স কিন্তু আমাদের চেয়ে বেশি জানেন। বর্তমান জেনারেশনে কিছু পোলাপান অনেক বেশি পড়ে। আমাদের পড়াশোনা খুবই কম। ফলে আপনার যে জানা-শোনা, আপনি জানেন যে, ধর্মের কিছু কিছু বিষয় কীভাবে বিত্রিক্র হয়। এটা কেনার লোক আছে। আমি আবুল বাশারকে ওটা বলব না। আমার মনে হয় তার প্রথম উপন্যাসের সাবজেক্ট ম্যাটারটা খুবই আকর্ষণীয়। এবং যারা ওইটাকে কিনতে আগ্রহী তাদের জন্য আকর্ষণীয় জিনিস। তার ভাষা তো ভালোই। একটা শক্তিশালী অবস্টÿান না হলে পশ্চিমবঙ্গে ওঠা খুব মুশকিল।


রে· ক·ঃ আমাদের অভিমানী লেখক মাহমুদুল হক···।
শ· জ·ঃ অসাধারণ। আমার ধারণা তিনি যেটুকু লিখেছেন ব্যাস, ফাইন। মাহমুদুল হক যেক'টা লিখেছেন, সেক'টার জন্য আপনারা যারা বাংলা সাহিত্য নাড়াচাড়া করেন তাকে স্টôরণ করবেন, না করলে করবেন না। আমাদের স্ট্বার্থেই তাকে মনে করা উচিত।


রে· ক·ঃ আপনার উত্তর-প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
শ· জ·ঃ উত্তর-প্রজন্মে লেখা খুব সিস্দ্বেমেটিক্যালি আমার পড়া হয়নি। আমি মাঝেমধ্যে কিছু কিছু লেখা পড়ি। অনেকের লেখা ভালো লাগছে, অনেকের নামও আমি ভুলে গেছি। সাহিত্য সাময়িকীতে অনেক লেখা আমি পড়ি, যেগুলো খুবই ভালো লেখা। হয়তো বছর দু'বছর আগে পড়েছি তাদের নামও ভুলে গেছি। তো এ রকম অনেক আছে সেটা বলা খুবই ডিফিক্যাল্কল্ট। আমি তো মনে করি জনদশেক খুব ভালো লেখে।


রে· ক·ঃ কয়েকজনের নাম যদি বলতে বলি?
শ· জ·ঃ একজন-দুজন মহিলা আছে, যারা খুব ভালো লেখেন। মনিরা কায়েস, অদিতি ফাল্কগ্দুনী আরো আছেন- আসলে এভাবে নাম বললে অনেকে বাদ পড়েন। মামুন হোসেন বেটার লেখক। রাশিদা সুলতানার লেখা ভালো লাগে। শাহাদুজ্জামান খুব ভালো লেখেন। প্রশান্স্ন মৃধা, তাদের লেখার অনেক সময় আছে। ফলে মন্স্নব্য করার জন্য কিছু সময় দরকার।


রে· ক·ঃ আপনার পরবর্তী লেখার পরিকল্কপ্পনা কী?
শ· জ·ঃ পরিকল্কপ্পনা এ মুহহৃর্তে মাথায় খুব অষ্দ্ব। গল্কপ্পই লিখব কিছুটা। একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে আমার; কিন্তু এটা কখন হবে আমি একদম সিওর বলতে পারছি না। এটা মাথাতেই আছে। উপন্যাসের পুরো স্দ্ব্রাকচার ঠিক করে আমি লিখি না।


রে· ক·ঃ আপনি যখন শুরু করেন তখন কি পহৃর্ব পরিকল্কপ্পনা মতো শেষ করেন, না কি লিখতে লিখতে একটা অবস্টÿার সৃষ্দ্বি যখন মনে হয় শেষ করা যায়।
শ· জ·ঃ কাঠামোর একটা অংশ অবশ্যই চিন্স্নার মধ্যে থাকে। কিন্তু পুরোটা থাকে না। কিছু কাঠামো নিয়ে শুরু করি, শুরু করার পর এটা আরেক দিকে যায়। যেমন- 'মুখের দিকে দেখি' এটা একেবারেই চিন্স্নার বাইরে।


রে· ক·ঃ 'মুখের দিকে দেখি' উপন্যাসের নামটা এ রকম হলো কেন?
শ· জ·ঃ আসলে নামটার কারণ হচ্ছে যে, এটা আসলে নস্দ্বালজিয়ার বিষয়। সব লেখায়ই ব্যক্তি থাকে, আমার এ রকম শিক্ষিকা ছিল। উপন্যাসে যে স্টড়্গুলের কথা বলা আছে, সে স্টড়্গুলে আমি পড়েছি। শিক্ষিকা মিসেস ক্লার্ক আমারও শিক্ষিকা ছিলেন। একদম ছোট বেলাতেই। তো 'মুখের দিকে দেখি' নামটার বিষয় হচ্ছে একটা ভালো লাগা থেকেই। ফার্স্দ্ব লুকিং হার ফেইস। সেটা ওই ছাত্র এবং শিক্ষিকার। সেটাকে আপনি প্রেম বলবেন তো সেটা ওই প্রেম প্রচুর ভালো লাগা শিক্ষিকার প্রতি।


রে· ক·ঃ শেষ পর্যন্স্ন ছাত্র চান মিয়া চোর হয়।
শ· জ·ঃ ওই ছাত্রের ওই রকম অবস্টÿাই হয়। সমাজের ওই স্টস্নর থেকে যতই চেষ্দ্বা করেন ও কোথাও যাবে না। একা বড় হওয়া যায় না, এটা সল্ফ্‌ভব না। সমাজের সবাই যদি ছোট থাকে। আর আপনি যদি তালগাছ হয়ে যান তাহলে কমিউনিকেশন বলে কিছু থাকবে না। ফলে ওই ছেলে চোরই হবে। ওই সিস্দ্বেমে এগিয়ে যাওয়া খুব ডিফিক্যাল্কল্ট। সে এক বছর, দু'বছর পড়তে পারে তার পর বসে যাবে। ওর যে পারিবারিক পরিস্টিÿতি ওকে বেশি দহৃর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সল্ফ্‌ভব না।


রে· ক·ঃ লেখকসত্তা আর ব্যক্তি সত্তাকে আপনি এক করে দেখেন না, আলাদা করে দেখেন?
শ· জ·ঃ এটা এক আবার পৃথক। এক হলে তো আর লেখা হবে না। তাহলে তো আত্মôজীবনী। লেখা লাগবে। তবে ফিকশনে লেখক প্রায় সবসময়ই থাকে আমার ধারণা।


রে· ক·ঃ ব্যক্তি শহিদুল জহির কি সুখী?
শ· জ·ঃ মানুষের সুখ খুবই ডিফিক্যাল্কল্ট বিষয়। সুখের যদি কতগুলো কনটেক্সক্ট দাঁড় করা যায় তাহলে ঠিক আছে।


রে· ক·ঃ এতক্ষণ আপনাকে কষ্দ্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আসলে আমি এত সময় নিতে চাইনি।
শ· জ·ঃ ঠিক আছে।
-
-
-

'পেদ্রো পারামো' এবং 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা'- পুনর্পাঠ

সালমা বাণী
-
সাধারণত আমরা উপন্যাস বলতেই ভাবি, কোনো একজন ঔপন্যাসিক বা লেখক শুধু তার কল্কপ্পনা থেকে তুড়ি মেরে বের করে আনেন ঘটনা পরিবেশ চরিত্র আর সেসবের পশ্চাৎপট। 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতার' কোথাও যেন উপন্যাসের সেই ব্যাপারটি নেই। নামের ভেতরই যেন এই ছোট্ট উপন্যাস বা নোভেলার বাস্টস্নবতা, যা নোভেলার পুরোটা জুড়ে ম্যাজিকের মতো রুদব্দশ্বাসে আবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা- বাংলাদেশের স্ট্বাধীনতা যুদেব্দর আগে ও পরের কাহিনী। সময়ের ত্রক্রম, বিভিল্পম্ন স্টÿান এমনকি ঘটনাগুলো পর্যন্স্ন বাস্টস্নবের সমান্স্নরাল আরেক বাস্টস্নবের নির্মিতি। পাকিস্টস্নান আর্মি, গোলাম আযম তার গং, স্ট্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মাটিতে রাজাকারদের পুনর্বাসনে দেশের অভ্যন্স্নরের চত্রক্রান্স্ন, এই চত্রেক্রর শক্তিসঞ্চারে বাধাদানে সমষ্দ্বিগত মিলনের অভাব; এসবই এই নোভেলার। ভিতরগত মহৃল সুর। এ নোভেল যেন ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণের নতুন ধাপ। পিছিয়ে পড়ার ভাবনায় আমরা যারা সারা পৃথিবীর লেখার খোঁজ করে বেড়াই, বেশিরভাগ তারাই কিন্তু নিজের বাড়ির খোঁজ রাখি না। তারাই সবসময় নিজেদের নন্দনচিন্স্নাকে পরখ করে দেখতে চাই পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে, এটাই পহৃর্বকাল থেকে শিখে এসেছি, কারণ আমাদের উপন্যাসের সচল ধারাটি বগ্ধিকম বাবুর হাত দিয়ে এসেছে, নকশার যে নিজস্ট্ব ধারা তার আদল আখ্যানে ব্যবহৃত হয়নি তেমন, পশ্চিমি আদলে স্ট্বদেশি মাটিতে চেরি ফলের আবাদ দোষের তেমন নয় যদি খাদ্যগুণসল্পম্ন হয়। একে অস্ট্বীকার করার র্ঙ্ধা এত দিনে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তবে অস্ট্বীকারের কথা বলছি না, বলছি নিজেদের চেনার কথা, আত্মôপ্রত্যয়ের কথা।এই লেখায় আমিও পশ্চিমি কোনো উপন্যাস না নিয়ে লাতিন আমেরিকার একটি ছোট উপন্যাসের তুলনা টেনেছি, পাঠক প্রধানত ধরতে পারেন, আত্মôপ্রত্যয়ের অভাব, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, পঠন-পাঠন দেখানোর ভান অথবা এই উপন্যাস আলোচনায় পহৃর্ববর্তী বাংলা উপন্যাসের কোনো প্রতিতুলনা বা সাদৃশ্য ও স্ট্বাতন্প্য চিহিক্রত করার মতো কিছু পাইনি বলে। যাই ভাবুন, 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা' নিয়ে 'কালের খেয়া'র সাদক কবি মাসুদ হাসান যখন লিখতে বললেন, তখন প্রথম 'পেদ্রো পারামো'র কথাটিই মনে পড়ল; শহীদুল জহিরের জাদুবাস্টস্নবতা আর হুয়ান রুলফোর জাদুবাস্টস্নবতা একেবারেই এক নয় যেমন, তেমনি সাদৃশ্যও কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। লাতিনিকরণ করে যারা শহীদকে হেয় করতে চান, তাদের পাঠ-অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদব্দা হারাই তখনই, যখন দেখি শহীদুল যে আপন ভুবন তৈরি করেন তার লেখায় তা একান্স্নই আমার স্ট্বদেশি যার অস্টিস্নত্ম্ব আমার মাটির শিকড়ে প্রোথিত। তাই শহীদুলকে পড়তে গিয়ে পেদ্রো পারামোর মতো অমন ছোট্ট উপন্যাস আবার পড়তে শুরু করি, যে উপন্যাসের চরিত্রেরা সব মৃত, তাদের স্ট্বদেশ ভাবনা চরিত্রদের কথোপকথন ও ভূ-মানচিত্র বাংলাদেশের স্ট্বাধীনতাকালীন সময়কেই মনে করিয়ে দেয়, মেক্সিকো ও বাংলাদেশ আমার কাছে একাকার হয়ে যায়, সময়হীন সময়ের মধ্যে চেনা-অচেনা এক রূপ-বাস্টস্নবতায়। তখনই 'উপন্যাসের নন্দন' প্রবল্পেব্দর কথা মনে আসে, যেখানে দেবেশ রায় ষ্দ্বই যে চিন্স্নার সহৃত্রের কথা বলেন, 'নন্দনচিন্স্নার নতুন সহৃত্র কখনোই তৈরি হয়ে উঠতে পারে না। নিজের ভাষার সৃষ্দ্বি বৈচিত্র্যের নতুন নতুন গভীর স্টস্নরের ভিতর ঢুকে যেতে না পারলে··· যখনই কোনো দেশে নন্দন আলোচনার নতুন সহৃত্র তৈরি হয়, তখনই সেই দেশের বা ভাষার শিল্কপ্পসাহিত্যের এক নতুন পাঠ আমরা পাই। শিল্কপ্প সাহিত্যকে অনিবার্যতই স্টÿানিক ও সাময়িক হতে হয়- দেশকালের দ্রাঘিমা-অক্ষাংশে সে এমনই বাঁধা। সেই স্টÿানিকতা ও সাময়িকতাকে বিশ্বজনীনে নিয়ে আসাটাই নন্দনসহৃত্রের প্রধান বা হয়তো একমাত্র কাজ। গ্রিস দেশ ছাড়া গ্রিক নাটক হতো না, গ্রিক নাটক ছাড়া অ্যারিস্দ্বটল হতেন না···'। এই যে 'অনিবার্যতাই স্টÿানিক ও সাময়িক'- কথাগুলো শহীদুল জহিরের সাতচল্ক্নিশ পাতার এই নোভেলা 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা'য় গভীরভাবে পরিম্ফুট। যা কি-না সঠিক অনুবাদ হলে স্টÿানিকতা ও সাময়িকতাকে ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে, কারণ মহান মুক্তিযুদব্দ নিয়ে এমন ছোট্ট পরিসরে আর কোনো মহৎ কর্ম বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্ফড়্গর, এখানে কোথাও লাতিনিকরণের দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। কিংবা ছোট করা যাবে না এমন মহৎ কর্মকে। আমি মনে করি, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা আমাদের স্ট্বাধীনতার ইতিহাসের সবাক দলিল। স্ট্বাধীন বাংলার মাটিতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়েছিল এদেশের স্ট্বাধীনতার স্টÿপতির মুখ দিয়ে। সেই স্ট্বাধীন দেশে বার বার হয়েছে ক্ষমতার পট পরিবর্তন। ঘটনাত্রক্রম এবং কালপঞ্জি- নিয়ে যেমন নিপুন ভাবে খেলা করেন হুয়ান রূলফো, আলোহো কার্পেন্স্নিয়ের, গার্সিয়া মার্কেজের তেমনি নিপুন খেলা খেলতে চেষ্দ্বা করেছেন, শহীদুল জহির। অনেকাংশেই সার্থক হয়েছেন, স্ট্বদেশের মাটিতে পারস্যের গোলাপের চাষ যেমন আপনার হয়েছিল এদেশে, তেমনি তিনি যোগ্যতার সাথে ম্যাজিক ও বাস্টস্নবতাকে প্রথম রোপন করেন বাংলায়। সদ্য স্ট্বাধীন শেকড়-বাকড় উপড়ানো একটা দেশ যেখানে প্রতিদিন ক্ষমতালোভীদের লড়াই, আচল্ফ্বিতে খেয়াল খুশি ইচ্ছামত হঠাৎ অভ্যুত্থান এ সবকিছুই লাতিন আমেরিকার চাইতে কোনো অংশে কম নয়, চিত্র আর বাস্টস্নবতার রূপটি হয়ত কিছুটা ভিল্পম্ন। হাত ধরে ক্ষমতালোভীরা পুনরায় সঙ্গী করে স্ট্বাধীনতা বিরোধীদের আর বিকলাঙ্গ করেছে স্ট্বাধীনতা ফসল- সেটা ছিল একাত্তর সনের ডিসেল্ফ্বর মাসের একত্রিশ তারিখ। কিন্তু দু'বছর পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে বদু মওলানা যখন লক্ষ্মীবাজারে ফিরে আসে মহলল্‌গার লোকেরা তার গায়ে পুনরায় পপলিনের ধহৃসর সেই আলখালল্‌গা দেখতে পায়। পুনরায় ফিরে আসার পর প্রথম দিনে সে মহলল্‌গার সকলের সঙ্গে বিনীতভাবে কুশল বিনিময় করে, সে একাত্তর সনে মহলল্‌গায় নিহত আট ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। মহলল্‌গার লোকেরা পরে তাদের এই বিশ্বাসের কথা বলেছিল যে, এই দুঃসাহসিক কাজের দ্বারা আসলে সে সাতটি ক্ষতচিহক্র পরীক্ষা করতে চেয়েছিল মাত্র। তখন সেই মঙ্গলবারের অপরাহেক্র আবদুল মজিদ তাদের প্রাঙ্গণের ফটকের কাছে কামিনী গাছতলায় বদু মওলানাকে বিনীত ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। কেমন আছো তোমরা? এই প্রশ্নের ভেতরকার পরিহাস এমন নিদারুণ ছিল যে, নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণের ভেতর তা শুনে এবং বদু মওলাকে দেখে আবদুল মজিদ বাক-রহিত হয়ে থাকে। এই আবদুল মজিদ যদি হয় আমাদের এই স্ট্বাধীন ভূখণ্ড তাহলে এই ভূখণ্ড তার সাত বীরপ্রতীকের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই প্রত্যক্ষ করেছিল স্ট্বাধীনতাবিরোধীদের সদর্প আগমন। সামাজিক আর রাজনৈতিক টানাপড়েনের তীব্রতাকে জীবন্স্ন করে তোলার জন্য বাস্টস্নব রূপায়ণের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কী অদ্‌ভুত সব কিল্ফ্‌ভূত কাল্কপ্পনিক সব উপাদান, যা আমার পাঠক হৃদয়ে লেখকের মতোই স্ট্বতোৎসারিত, স্ট্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে আবর্তিত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারায় লিখিত আপাত মনে হলেও শহীদুল জহির বাস্টস্নবে কল্কপ্পনার মিশেল দিয়ে রচনা করেছেন এক নতুন ভূখÐের নতুন শিল্কপ্পধারার ইতিহাস। যা তার পহৃর্বসহৃরি ওয়ালীউল্ক্নাহর রচনাতেও আবাস মেলে, বিশেষ করে 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসের প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায়। হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো'র কোমালা, গার্সিয়া মার্কেজের 'এক শ' বছরের নিঃসঙ্গতায়' যে জনপদের পত্তন হলো, তা ওই সকল লেখকদের মায়া-কল্কপ্পনারই সৃষ্দ্বি, নতুন ইতিহাস বা ঐতিহ্য। কেননা লাতিন আমেরিকার কোথাও কোমালা বা মাকোন্দো নামে কোনো গ্রাম বা শহর নেই। আমাদের যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ট্বপেম্নর দ্বীপ ময়নাদ্বীপও নেই বাংলাদেশের কোথাও। কিন্তু শহীদুল জহিরের নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার সব তো আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত ইতিহাসের কেন্দ্রে বিদ্যমান। তবে গার্সিয়া মার্কেজের মতো শহীদুল জহিরও শেষ পর্যন্স্ন এসে পৌঁছেছেন ইতিহাসেরই এক সজীব সংজ্ঞার্থে। মহল্ক্নার প্রতিটি বালক এবং বালিকার কাছে, পুরুষ এবং রমণীর কাছে যেন এই প্রথম উঞ্ছঘাটিত হয়েছিল যে, জগৎ সংসারে একটি ব্যাপার আছে যাকে বলে বলাৎকার। তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে কিছু বোঝে নাই, যেখানে একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগিকে; মহল্ক্নায় মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, প্রাঙ্গণের মুরগির মতো তার মা এবং কিশোরী কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার স্টপী, তাদের চোখের সামনে প্রাণভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে··· পাকিস্টস্নানি মিলিটারি এক ঘণ্টায় বিশ লক্ষ বছর ধরে মানুষের বুনে তোলা সভ্যতার চাদর ছিঁড়ে ফেলে এবং লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা তাদের মহল্ক্নায় মানুষের গুহাচারিতা হাজার এবং লক্ষ বছর পর এক মর্মান্স্নিক অক্ষতম পুনরায় অবলোকন করে। শহীদুল জহিরের এই উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় কতটা ক্ষোভ, কত ঘৃণা লালিত হয়েছে ঔপন্যাসিকের গভীর মননে। এই উপন্যাসের পটভূমি হলো স্ট্বাধীনতা যুদেব্দর পটভূমি এবং যুদেব্দাত্তর দেশে রাজাকারদের সদল্ফে্‌ভ পুনর্বাসন এবং ক্ষমতায়ন। এটা সল্ফঙ্হৃর্ণভাবে একটি খোলামেলা রাজনৈতিক উপন্যাস, পোস্দ্বমর্ডানিজমকে পাত্তা না দিয়ে এটা নিঃসংকোচ বাস্টস্নবের আখ্যান। কিন্তু আশ্চর্য তা আবার রাজনৈতিক ইশতেহারও হয়ে ওঠেনি। পরতে পরতে মিশে আছে স্ট্বপম্ন এবং প্রেম, সা্রদায়িকতা এবং মানবজীবনের হতাশা। এ তো জাদুবাস্টস্নবতা নয়, বাস্টস্নবের জাদুস্টিè্নয়া। ইতিহাস, বাস্টস্নব আর স্ট্বপম্ন সময় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে উপন্যাসটি পরিণত হয়েছে বাস্টস্নবের পরপারে কোনো অধিকতর বাস্টস্নবে, সময়ে। স্ট্বল্কপ্প পরিসরে মাত্র কয়েকটি লাইনে একেকটি চরিত্রকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার বাহাদুরি ও জাদুকরি খেলা খেলেছেন শহীদুল জহির। কোন চরিত্রটি প্রধান হয়ে উঠবে, সেটা বোঝার আগেই আরেকটি চরিত্রকে প্রধান করে তোলেন অর্থাৎ সেই চরিত্রের ক্ষণিক উপস্টিÿতি কতটা গুরুত্ম্বপহৃর্ণ অথবা সেই চরিত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা বাক্যাবলি বহন করে উপন্যাসের বিশদ তাৎপর্য- উপন্যাসটিতে ঘটনার বাস্টস্নবতার সঙ্গে বর্ণনার জাদুবাস্টস্নবতা এক নতুন মাত্রা এনে দেয়- যা ট্র্যাডিশনাল ইউরোপীয় উপন্যাসের ধারাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, যার ফলে বগ্ধিকমচন্দ্রের হাতে তৈরি হওয়া বাংলা উপন্যাসে অভ্যস্টস্ন লেখকরা কিছুটা বেকায়দায় পড়তে পারেন।পেরুর লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা, ১৯৬৭ সালে ভেনেজুয়েলার কারাকাসে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে কাগ্ধিক্ষত ও সল্ফôানিত সাহিত্য পুরস্টড়্গার 'রোমুলো গাইয়োগাস' গ্রহণের সময় তার ছোট্ট ভাষণটিতে স্টষ্দ্ব করে বলেছিলেন, সাহিত্য হলো 'আগুন'। কেননা সাহিত্যের আছে দুটি অঙ্গীকারঃ এক তার শিল্কেপ্পর কাছে, শিল্কপ্পী তার কাছে; আর দুই মানুষের কাছে, সমাজের কাছে, দেশের কাছে। এ আগুন সারাক্ষণ স্ট্বয়ং সাহিত্যিককেই পোড়ায়; কিন্তু অন্য আগুন পোড়ায় সমাজ ও রাজনীতির যত অন্যায়, যত জঞ্জাল। শিল্কেপ্পর আর জীবন দর্শনের জ্বলন্স্ন শিখা- শহীদুল জহিরের রচনায় দপদপ করে জ্বলে উঠেছে- 'থুক দেই থুক দেই থুক দেই মুখে।' বদু মওলানা জানে আবদুল মজিদরা একাত্তরের নয় মাসের কথা ভোলে নাই। হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামোকে যেমন বলা হয় মেক্সিকোর আত্মôা থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য উপন্যাস, তেমনি জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য নোভেলা। পেদ্রো পারামোর চেয়েও ছোট্ট নোভেলা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা- মাত্র আটচল্ক্নিশ পাতার এই নোভেলার প্রতি বাক্যের শরীরজুড়ে জ্বলজ্বল করছে চাপা বিদ্বেষ। হুয়ান রুলফো আশ্চর্য দক্ষতায় থামিয়ে দেন চরাচরকে, আর শহীদুল জহির সেই দক্ষতার উত্তরসহৃরি হয়ে জাগিয়ে তোলেন রায়েরবাজারের বধ্যভূমিকে। মোমেনাকে আবদুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্স্নে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর। আবদুল মজিদ এখন বুঝতে পারে না এই চার দিন তার আদৌ সংজ্ঞা ছিল কি-না। তার এখন শুধু মনে পড়ে খুঁজে খুঁজে সে যখন মোমেনাকে পায় সেই সময়টিকে। সে তখন তার বোনকে দেখে- তার একটি কেটে ফেলা, পেট থেকে ঊরু পর্যন্স্ন ক্ষতবিক্ষত, ডান ঊরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্স্ন চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা।নির্যাতনের এই চিত্র প্রত্যক্ষ করতে করতে পাঠকের দম বল্পব্দ হয়ে আসবে অপরদিকে যুদব্দবন্দি মানুষদের মতো আরেক মোমেনা এদিকে প্রতিনিধিত্ম্ব করে লক্ষাধিক নির্যাতিত নারীর। লক্ষ্মীবাজারের লোকদের মনে পড়ে একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহলল্‌গার আকাশে। এক থালা মাংস নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। ··· একটি অদেখা মেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের এক বিষণ্ন বৃদেব্দর হৃদয় সেদিন ভেঙে পড়ে। এখন তার বাড়ির আঙিনায় তার নিজের আর তার বড় ছেলের জোড়া কবর। অন্য আরেকটি টুকরো পড়েছিল জমির ব্যাপারীর বাড়ির কুয়োতলায়, বিকেলে ভাতের চাল ধোয়ার সময়, হাঁড়ির ভেতর। এটা ছিল একটি কাটা পুরুষাঙ্গ। হাঁড়ির ভেতর এসে পড়তেই জমির ব্যাপারীর কিশোরী কন্যাটি চমকে উঠেছিল, কিন্তু হাঁড়ির ভেতর থেকে বের করে এনে সে বস্টçটি চিনতে পারে নাই।ছোট্ট একটি উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই হত্যা-খুন, অত্যাচার-নিপীড়ণের চিত্র দু'পাড় ভাঙা খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। রাজাকার আর পাকিস্টস্নানি আর্মিদের এই নির্যাতন থেকে যেমন রেহাই পাইনি নারী, পুরুষ, উভয়লিঙ্গ; রেহাই পায়নি তেমন বাড়ির পোষা প্রাণী কুকুর পর্যন্স্ন। নবাবপুর এবং লক্ষ্মীবাজারের বিধ্বস্টস্নরূপ হয়ে ওঠে সারাবাংলা। আমাদের সমস্টস্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে তা ত্রক্রমাগত জীবন্স্ন হয় যে, এর সব পরিবেশ আষ্দ্বেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পাঠককে। আমরা যেমন শিউরে উঠি, তেমনি আমরা দেখতে পাই আমাদের নড়বড়ে অস্টিস্নত্ম্ব। যুগপৎভাবে ভয়গ্ধকর নয়, মারাত্মôক হিংস্র অনুপুগ্ধখ গল্কপ্প সৃষ্দ্বি করেছে শহীদুল জহির আশ্চর্য দক্ষতায় গল্ফ্‌ভীর প্রখর অথচ সহজ, অনায়াস, স্ট্বতঃস্টম্ফূর্ত ভঙ্গিমায়; মনেই হয় না যে কোথাও একটা প্রখর শিল্কপ্প বোধ কাজ করে যাচ্ছে। কাটা কাটা, চাঁছাছোলা, নিরাসক্ত, নির্বিকার ভাষা, বাস্টস্নব রূপদানে বাস্টস্নবতার জাদুকরি মিশেল অথচ এই মায়া আখ্যানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোথাও বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বয়ান তিনি দেননি বরং বোঝাতে চেষ্দ্বা করেছেন এবং পেরেছেন কিসের ব্যঞ্জনা তৈরি করতে চাচ্ছেন। আর নয়তো কুয়াশার পর্দার মতো হয়ে ওঠে আখ্যানেরই কেন্দ্রীয় চিত্রাভাস। বোঝাই যায় না কী কঠোর শ্রমে ঘষে ঘষে অতিরিক্ত বোঝা ফেলে দিতে দিতে এই ঊনকথনের ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছেন। কোনো অলগ্ধকার যেন নেই কোথাও; কিন্তু পার্ট পার্ট নিভাঁজ সজ্জিত, ভয়ানক বাস্টস্নব হয়ে উঠতে তার গা কাঁপে না। তার চিত্রকল্কপ্প স্টÿানিক বৈশিষ্দ্ব্যে ভরপুর- ত্রক্রমাগত নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার একটি যুদব্দবন্দি মহল্ক্না- মহল্ক্নার ভেতরের দুঃসহ অসহায় বন্দি মানুষ, পরিবেশ, তুলসীগাছ, কাক, উইপোকা, হাজামের ক্ষুর, কর্তিত পুরুষাঙ্গ- ব্যাপ্টস্ন হতে হতে পরিব্যাপ্টস্ন হয় একটি ভূখÐে, একটি মানচিত্রে। কিন্তু কল্কপ্পচিত্র কখনো গায়ের জোরে আখ্যানের ভেতর ঢুকে পড়ে না- সে হয়ে ওঠে ইঙ্গিত বা ব্যঞ্জনার অংশ অথবা একান্স্ন সঙ্গী। আমরা আমাদের সমস্টস্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে তাই অনুভব করি- দীর্ঘ একটি যুদেব্দর তাবৈ। ঠাwৈ মাপা মাপা নিরাভরণ গদ্য- বাস্টস্নবতার জাদুতে মোড়ানো এই ঐতিহাসিক উপন্যাস একদিন হয়ে উঠবে আমাদের আত্মôানুসল্পব্দানের ইতিহাস, যার শেকড় প্রোথিত কঠিন বাস্টস্নবের ভেতর। এ কারণেই এটা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্টস্নবতা। আমরা জানি যে কোনো ভালো লেখাতেই সে লেখা কীভাবে পড়তে হবে, তার চাবিটাও লুকিয়ে থাকে। শহীদুল জহির চেয়েছেন, তার পাঠকরা তার উপন্যাসের চরিত্র হয়ে অংশগ্রহণ করুক। বাক্যের পর বাক্য ভেঙে বিশেল্‌গষণ করে পাঠকরা বের করে নেবেন এর মহৃল শাঁস, যেহেতু নোভেলার কোনো প্রচলিত গড়নও মানা হয়নি এই নোভেলা বা ছোট্ট উপন্যাসে। এ এমন এক নোভেলা, যেখানে লেখক নিজে অনুপস্টিÿত থেকে বলে যাচ্ছেন পাঠককে কী করতে হবে আর তা না হলে তাকে আপাতত বদলাতে হবে তার ঠিকানা।

-

-