Tuesday, November 6, 2007

টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার

.
কিছুদিন আগে ‘একুশের রাতে’ অনুষ্ঠানে বেশ হালকা মেজাজের কথোপকথনের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উঠে এলেও সেগুলো নিয়ে সেদিন বিশদভাবে আলোচনা হয়নি। মনে হলো, সেদিনের পর্বটিকে উপস্থাপক খুব সিরিয়াস বিষয়বস্তু দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। তবে ওই আলোচনার দুটি বিষয়কে আমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়েছে বলে আমি এ নিয়ে ভবিষ্যতে আবার আলোচনা করার জন্য অনুরোধ রাখব। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে শিল্পী বা শিল্পের সামাজিক দায়ভার এবং অন্যটি হচ্ছে নাটকের ডায়ালগে আমাদের দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহার। দুটি বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্কের অবতারণা হতে পারে বা এর মধ্যেই হয়েছে বলে আমি মনে করি। এসব বিষয়ে কিছু ঐকমত্য তৈরি হলে পরবর্তী প্রজন্ন, বিশেষ করে এ দেশের শিশু-কিশোরেরা উপকৃত হবে। উল্লিখিত প্রথম বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক এবং দ্বিতীয় বিষয়টি প্রথমটির অন্তর্ভুক্ত। আমি আজ দ্বিতীয় বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে চাই। অর্থাৎ নাট্যকার তাঁর চরিত্রগুলোর কথোপকথনে স্বতঃস্কুর্ততা ও সাবলীলতা আনার উদ্দেশ্যে আমাদের ঘরে বলা দৈনন্দিন জীবনের ভাষাটিকে ব্যবহার করবেন কি না।
যে নাট্যকার বা কথাসাহিত্যিক এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে প্রথম এ ধারাটির অবতারণা করেছেন, তাঁর সেই নাটকটির প্রতিটি বিষয়বস্তু যে অসাধারণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ধারাটি যে নাটকটিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে, সেই নাট্যকারের রসবোধটি অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। একুশের রাতের সেদিনের আলোচনায় বলা হয়েছিল, শিল্পীর অধিকার রয়েছে তাঁর নিজের সৃষ্টিকে নিজের মতো করে পরিবেশন করার। আমার ভাবনাটি যে জায়গাটি থেকে তৈরি হচ্ছে তা হলো, আমাদের দেশের শিশুরা, যাদের প্রমিত বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন রয়েছে, তারা কোনটিকে মানদন্ড হিসেবে দেখবে। আজকালকার শিশু-কিশোর, আমরা জানি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতি খুব বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এই শক্তিশালী গণমাধ্যমে যদি তারা এ ধরনের বাংলা ভাষা শুনতে থাকে, তাহলে তাদের ভাষার বিকাশে এটি কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা কিন্তু আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশে অনেক আঞ্চলিক ভাষা থাকার কারণে আমরা নাটকের ডায়ালগে সেগুলো প্রায়ই শুনতে পাই এবং সে পর্যন্ত থাকাটা ঠিকই আছে। সেই সঙ্গে যদি শুদ্ধ বাংলার চর্চাও কমে যায়, তাহলে আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারি। কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা আজকাল বাংলা সাহিত্য খুব কমই পড়ছে। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, কবিগুরু রবীদ্রনাথ ঠাকুর এদের জীবনে প্রায় অনুপস্িথতই বলা যায়।
এ ছাড়া হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল, ইংরেজি গান ও ছবি, নানা রকম ডিজুস বাংলার ব্যবহার শিশু-কিশোরকে প্রমিত বাংলা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। মোবাইল ফোনের পাঠানো মেসেজে ইংরেজি শব্দের নানা রকম ভুল প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘আমাকে ফোন দিয়ো’, ‘ওর বিহেভ ভালো না’, ‘তোমাকে রিমাইন্ড দিচ্ছি’ ইত্যাদি। এ ছাড়া ই-মেইল, চ্যাটিং ইত্যাদিতেও শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার খুব কম দেখা যাচ্ছে। নানাভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে ভাষার ছড়াছড়ি করে চিঠি লেখার চর্চা তো বন্ধ হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। অনেকেই চর্চার মাধ্যমে তাদের বাংলাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার পরিবর্তে ভুল ইংরেজিতে কথা বলাকে বেশি সম্মানজনক মনে করছে।
এখনকার যুগের ছোট্ট শিশুদের আর ঠাকুরমার ঝুলি থেকে গল্প পড়ে শোনানো হচ্ছে না, যা তাদের কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করে তুলতে পারত। এ কারণেই তারা কিশোর বয়সে পা রেখে সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, শিবরাম চক্রবর্তী ও নীললোহিতের সঙ্গে আর আগের মতো পরিচিত হচ্ছে না। এ ছাড়া বিশেষভাবে কিশোরদের জন্য সংকলিত ম্যাগাজিনগুলো তাদের কাছে কতটা আদৃত হচ্ছে বা যথেষ্ট উন্নতমানের ম্যাগাজিন প্রকাশনার ব্যাপারে মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে কি না, আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমাদের দেশের কিছু লেখক কিশোরদের জন্য লিখছেন বটে, তবে এ যুগের মা-বাবারা সন্তানদের সেগুলো পড়তে কতটা অনুপ্রাণিত করতে পারছেন, সে ব্যাপারটিও খুব একটা আলোচনায় আসছে না। আগে যে পাড়াগুলোতে পাঠাগার ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত হতে বসেছে। প্রাক-বিদ্যালয় বয়সী শিশুদের জন্য তেমন কোনো আকর্ষণীয় সাহিত্য বা বইয়ের সিরিজ আমরা এখনো পাইনি। ইলেকট্রনিক যুগের জোয়ারে ঠাকুরমার ঝুলি, রাজা-রানির গল্প ভেসে গেছে অনেক দুরে। সেই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে নানা রকম কম্পিউটার গেম ও কার্টুন চিত্র। মা-বাবারা শিশুদের টেলিভিশন বা কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন। ছোট্টমণিদের হাতে বই তুলে দিতে হলে নিজেদেরও যেহেতু সময় দিতে হবে, সেহেতু তারা অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমকেই বেশি সুবিধাজনক মনে করছেন। এসব কারণে সঠিক উচ্চারণে শুদ্ধ বাংলা বলা বা লেখা শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের খুদে নাগরিকেরা।
এ সবকিছু পর্যালোচনা করে আমার যে কথাটি বারবার মনে হয়−আমরা যেন শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকারদের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে গিয়ে শিশু-কিশোরদের সঠিক ভাষা শেখার বিষয়টি বিস্নৃত না হই। তাঁরা হয়তো বলবেন, সাহিত্য বা নাটক তো বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা হয়, স্কুলের শিক্ষকদের দায়িত্বের ভার তো তাঁদের নেওয়ার কথা নয়। এ কথাটির উত্তরে আমি বলব, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুরা যেভাবে বইয়ের ভারে ভারাক্রান্ত অবস্থায় রয়েছে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে অনুপাত, সেখানে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমি বলব, কিছু নাটকে প্রতিদিনের বলা ভাষা ব্যবহূত হয়েছে এবং সেগুলো দর্শকনন্দিত হয়েছে বলেই এটিকে একটি আদর্শ হিসেবে আমরা যেন বিবেচনা করতে শুরু না করি। একটি নাটক অনেক কারণেই দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন তা তাদের স্নৃতিতেও থাকে−সেই কথাটি আমাদের মনে রাখতেই হবে। যখন বাংলাদেশে এত চ্যানেল ছিল না, শুধু বিটিভি দেখেই আমরা তৃপ্ত ছিলাম; তখনো এমন কিছু নাটক হয়েছে, যেগুলো আমরা আজও ভুলতে পারিনি। সেই নাটকগুলোতে তো আটপৌরে ভাষার ব্যবহার ছিল না।
আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য অসংখ্য পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ধারাবাহিক নাটক তৈরি হচ্ছে। এগুলোর যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে বলেই নাটক লেখা এবং নির্মাণের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন অনেকেই। প্রায় সব বয়সের ছেলেমেয়েরা যেহেতু অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে এগুলো দেখছে, এর মাধ্যমে যদি বিনোদনের পাশাপাশি কিছু মূল্যবোধ ও সঠিক ভাষা শেখানো সম্ভব হয়, তাহলে এতে বাড়তি পাওনা হবে বলেই মনে হয়। এ দেশের সম্মানিত নাট্যকার আর লেখকদের প্রতি তাই আমার অনুরোধ, তাঁরা যেন বিষয়টিকে একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন। কথাশিল্পীর স্বাধীনতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা দুটোরই ভারসাম্য কোনোভাবে করা যায় কি না সেটি বোধ হয় বের করা সম্ভব। যে দেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সে দেশের শিশুরা শুদ্ধ উচ্চারণে বলা প্রমিত বাংলার সঙ্গে অশুদ্ধ উচ্চারণকে পার্থক্য করতে শিখুক−সেটি আমরা চাই। শুদ্ধ উচ্চারণের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সচেতনতার বেশ অভাব বা কিছুটা উদাসীনতাও যে রয়েছে, সেটি অনেকেই স্বীকার করবেন। একটি মানুষ যখন শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলে নিজেকে কোথাও উপস্থাপন করে, তখন নিঃসন্দেহে সে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেটি তখন তার আত্মবিশ্বাসকেও কিন্তু অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা চাই আমাদের দেশের সন্তানেরা অন্তত একটি ভাষার ধারাকে প্রমিত বাংলা হিসেবে গ্রহণ করতে শিখুক। ভাষা নিয়ে তাদের বিভ্রান্তিগুলো দুর করার দায়িত্বটি শুধু নাট্যকার বা সাহিত্যিকদের ওপর দিলে তাঁদের প্রতি নিশ্চয়ই অন্যায় করা হবে। তাই আমি পরিশেষে বলব, এ বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদভাবে বিতর্ক ও সংলাপ চলুক, যাতে আমাদের শিশু-কিশোরদের মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবে মিশ্রভাষা ব্যবহারের প্রবণতা থেকে রক্ষা করার একটি উপায় খুঁজে পাওয়া যায়।

ড. মেহতাব খানম: অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৬ নভেম্বর, ২০০৭
.

No comments: