Monday, November 12, 2007

প্র তি ক্রি য়া: আটপৌরে ভাষায় ঘৃতাহুতি

.
গত ৬ নভেম্বর প্রথম আলোয় মেহতাব খানমের আটপৌরে ভাষার ওপর লেখাটা পড়েছি। চলচ্চিত্র, রেডিও, টিভি, বিজ্ঞাপন, ইন্টারনেট, মুঠোফোন ইত্যাদিতে ইদানীং যে ভাষায় কথাবার্তা বলা শুরু হয়েছে তাতে একশ্রেণীর উদ্ভাবক ভাবছেন−এটাই আমাদের বাংলাদেশিদের মিডিয়া-সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিত। তাহলে বোধ হয় পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা থেকে আমাদেরটা আলাদা করা যাবে। আমাদের দেশের খুবই প্রতিভাবান কয়েকজন তরুণ কবি ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা এ ভাষার উদীয়মান প্রতিভু বা পথিকৃৎও বলা চলে। আট-নয় বছর আগে ইন্টারনেটে ই-ম্যাগাজিন চালু করে এসব কবি-সাহিতিকের কাব্যচর্চার পাশাপাশি চিঠিপত্রের ভাষাতেও আটপৌরে ভাষার প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাঁদের কেউ প্রতিষ্ঠিত দৈনিকে কবিতা লেখেন ‘বিল্লাল হালিম খাইতাছে’ শিরোনামে। কেউ চিঠি লেখেন ‘প্রিয় অমুক, কী করতাছস আইজকাল? লেখা কি ছাইড়া দিলি? তয় যোগাযোগডা চালাইয়া যাছ’।
একটা নতুন ধারার ভাষা প্রবর্তনের জন্য এসব ভাষার ব্যবহার তাঁরা মনে হয় সচেতনভাবেই আরোপের চেষ্টা করছেন। তাঁরা হয়তো বলতে পারেন বিদ্যাসাগরীয়-বঙ্কিমী রীতি কি আমরা এখনো অনুসরণ করি? রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র পর্যন্ত তাঁদের প্রথম দিককার গল্প-উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীর মুখের সংলাপে ‘উহার কান মলিয়া দাও’ ধরনের সাধু ভাষা ব্যবহার করেছেন। পরে গল্প-উপন্যাসের ভাষা সাধু রীতির হলেও যুগের প্রয়োজনে সংলাপের ভাষা চলিত রীতিতে পর্যবসিত করতে পেরেছিলেন, যা বিদ্যাসাগরের কাছে অভাবনীয় ছিল। তো এত যুগ পর আমরা যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই যদি শিল্প-সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার করা যায়, তাহলে ক্ষতি কী−ভাবছেন তরুণ বৈপ্লবিকেরা। তরুণ চলচ্চিত্রকারেরা চলচ্চিত্রে এ ধরনের ভাষার ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন। তাঁরা বলতে চান অভিনয় আর যাত্রাপালার মতো হবে না। অভিনয় হবে স্বাভাবিক জীবনাচরণের মতো। আমরা পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যেভাবে কথা বলি, নাটকের ভাষাও হবে সে রকমই। তাহলে তা দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি পাবে।
কেউ কেউ ঢাকাশ্রয়ী একধরনের ভাষা আনছেন, অন্যদিকে কেউ কেউ আনছেন কুষ্টিয়া-যশোরের ভাষা। এখন যদি এক পক্ষ দাবি করে, মিডিয়ার ভাষা হবে বৃহত্তর খুলনা-রাজশাহী অঞ্চলের−অন্য দল বলে, না, ঢাকা অঞ্চলের। তাহলে কোন ভাষাকে মিডিয়া-প্রযোজ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে? ‘কানতাছস ক্যা’, ‘কই যাইতাছ’ বা ‘ক্যামনে বুঝুম’−এসব ভাষা যেমন কেবল ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনি ‘কনে যাচ্ছ’, ‘কিরাম কইরি বুইজব’ ইত্যাদি ভাষাও মিডিয়া, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ভাষা হতে পারে না। সিনেমা-নাটকে রাজশাহী-খুলনা অঞ্চলের ভাষা শুনে যেমন ঢাকা মহানগরীতে বসবাসরত ওইসব অঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা মজা পান, তেমনি ‘অহনই যাওন লাগব’ শুনে পূর্বাঞ্চলের মানুষেরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন; কিন্তু পদ্মার ওপারের মানুষেরা তেমনধারা একাত্ম অনুভব করেন না। বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা সে অঞ্চলের জনজীবনকে তুলে ধরার জন্য চলচ্চিত্রে আসতেই পারে। কিন্তু যা সর্বজনীন বলে গ্রাহ্য হবে, সেখানে একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রমিত ভাষা আবশ্যক। আমাদের বাংলা ভাষার চলিত রীতি এই প্রমিত ভাষাকে তুলে ধরে। যাঁরা উদ্ভট আটপৌরে ভাষাকে প্রমোট করতে চাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো যুক্তি দেখাবেন ভাষা তো প্রবহমান নদীর মতো। ভাষার গতিও থেমে থাকে না। মিশ্রণে-সংমিশ্রণে ভাষা তার নব নব রূপ ধরে এগোতে থাকে। বিষয়টা ভিন্ন। এক ভাষায় অন্য সংস্কৃতির আগমনে ভাষার ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে পারে; কিন্তু ব্যাকরণশুদ্ধ ভাষারীতির পরিবর্তন হয় না। অনেকে বলতে পারেন, কথ্যভাষাও কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। মানুষ বিজ্ঞানের দ্রুততম যুগে পথ চলতে শুরু করেছে। দ্রুততা যেমন জীবনযাপনে, তেমনি কথাবার্তায়ও চলে আসবে−এ তো স্বাভাবিক। যেমন ইদানীং ইংরেজিতে want to-কে wanna, going to-কে gonna উচ্চারণ করা হচ্ছে। তেমনি দ্রততার জন্য ‘আমি এসেছি’ না বলে ‘আমি এসছি’ হতেই পারে। কিন্তু তা যদি কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে ‘আমি আইছি’ হয়, তবে তা সমগ্র দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
কয়েক দিন আগে টিভিতে ওই তথাকথিত আটপৌরে ভাষার একজন সম্মানিত সমর্থক সাময়িকী নামের একটা শিল্প-সাহিত্যালোচনার অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন। দারুণ স্নার্ট ও আকর্ষণীয় চেহারার ভদ্রলোক−মনে হচ্ছিল তাঁর কথার মধ্যে জোর করে তথাকথিত ঢাকাইয়া ভাষা আরোপের চেষ্টা করছিলেন। যেমন ‘ওটা আমরা করেছি’কে বলছিলেন ‘ওটা আমরা করছি’। অনেক সময় এসব উচ্চারণ ব্যাকরণের ‘কাল’কে বিভ্রান্ত করে। যদি কোনো তথ্য-প্রমাণের জন্য তিনি কোথাও হাজিরা দেন, এ ধরনের উচ্চারণ তাঁকে বিপাকে ফেলতে পারে।
অধ্যাপক মেহতাব খানম তাঁর যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র-নাটক-বিজ্ঞাপনগুলো খুবই উপভোগ্য, এতে সন্দেহ নেই। তাঁর মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের বাংলা ভাষা বিষয়ে দায়িত্বও কিন্তু কম নয়। আমাদের ভয়টা কোথায়? ‘ভাষার আগুনে দু ফোঁটা ঘি’ শিরোনামের প্রতিক্রিয়ায় (প্রথম আলো, ৮.১১.২০০৭) ফারুকীর মতামত উল্লেখ করে বলতে হয় পূর্ববাংলার বাংলা ভাষার অঢেল বৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই মনে রাখতে হবে যে নাটকের টিপিক্যাল ভাষা কিশোর বা তরুণদের গ্রাস করে যেন ওই ভাষাকেই প্রমিত করে না তোলার প্রয়াস পায়। কেননা আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষা করার অধিকার আমাদের সবারই। একটা মিথ্যাও দীর্ঘদিন ধরে সত্য বলে প্রচারিত হতে থাকলে, তা সত্যে পরিণত হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করেন। আমি কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে আসা ঢাকার অধিবাসী। আমার অঞ্চলের ভাষা নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ গর্বও আছে। কিন্তু ঢাকায় জন্নানো বা বড় হওয়া আমার ছেলেকে যদি জিজ্ঞেস করি−‘কিরে আজ টিভি দেখবি না?’ সে বলে, ‘আবার জিগায়’!

উম্মে মুসলিমা: প্রথম আলোর পাঠক।
lima_umme@yahoo.com ১২ নভেম্বর ২০০৭
.

No comments: