Friday, April 11, 2008

বন্ধুদের স্মৃতিতে

ফয়জুল ইসলাম
--


গত ২৩ মার্চ ২০০৮ এ বাংলা কথাশিল্পের অনন্য একজন রূপকার শহীদুল জহির মৃত্যুবরণ করেছেন। নিভৃতচারী এ লেখকের বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। জানা যায়, ৭০ দশকের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় তিনি চার-পাঁচ জনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন। কিš' তাঁর সে সময়কার বন্ধুদের কোনো খবর আমরা জানিনা। লেখকের জš§স্থান পুরানো ঢাকার ভূতের গলি এলাকার বন্ধুদের খবরও আমাদের অজানা। একইভাবে আমরা জানিনা, তাঁর পৈতৃক বাড়ি মগবাজার নয়াটোলা-তে কারা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর কারো কারো সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। লিখালিখির সূত্রে কেউ কেউ তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন বলে আমরা জানি।
শহীদুল জহিরের ছোট ভাই হাবিবুল হক ফোনে আমাকে বলেছিলেন - আসলে শহীদ ভাইয়ের অনেক ধরনের বন্ধু ছিল, যদিও বা হাতে গোনা। তাঁর বন্ধুবৃত্তকে বিভিন্ন কমপার্টমেন্টে ভাগ করা যায়। হাবিবুল হকের সাথে ঐক্যমত্য না হয়ে পারা যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চাকরিসূত্রে যারা শহীদুল জহিরের কাছে এসেছিলেন এদের বেশির ভাগই তাঁর গল্প বা উপন্যাস পড়েননি। এরকম কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের কারণ লেখকের ব্যক্তিচরিত্র। সচারাচর তিনি কারো সাথেই খোলামেলাভাবে মেশার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না। ব্যতিক্রম ঘটেছিল সেসব মানুষের ক্ষেত্রে যারা কোন না কোন কারণে তাঁর আশেপাশে ছিলেন এবং সে নৈকট্য ছাড়াও যারা সাহিত্যিক অথবা সাহিত্যানুরাগী। বন্ধুদের এ দলটির সাথে শহীদুল জহিরের মনোজাগতিক যোগাযোগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ দলের মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ক'জনের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে - আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, খোরশেদ আলম, ওয়াসি আহমেদ, মোহাম্মদ সাদিক প্রমুখ।শহীদুল জহিরের জানাজার নামাজ হয়েছিল বাংলাদেশ সচিবালায়ে যেহেতু তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যš-। জানাজার নামাজ থেকে শহীদুল জহিরের বন্ধু লেখক খোরশেদ আলম তাঁর নিজের অফিসে ফেরার পর আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। আমরা দু'জন চেষ্টা করি মৃত বন্ধুর জন্য শোক ভাগাভাগি করে নিতে। কিš' নৈঃশব্দ ছাড়া কিছুই তখন থাকে না আমাদের দু'জনের সামনে। ৩১ মার্চ ২০০৮ এর দুপুরে খোরশেদ আলম আমাকে তাঁর অফিসরুমে ডাকেন। পরিকল্পনা কমিশনের ১৪ নম্বর ব্লকে আমি ঠিক তাঁর ওপরের রুমে বসি। শহীদুল জহিরকে নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আনিসুল হক, মোহাম্মদ সাদিক, অদিতি ফাল্গুনী এবং ইমতিয়ার শামীমের লেখা তিনি পড়েছেন। লেখাগুলো পড়তে পড়তে শহীদুল জহির সংক্রাš- কিছু স্মৃতি তাঁর মনে এসেছে। খোরশেদ আলম আর শহীদুল জহিরের অনেক আগের কথপোকথন থেকে আমি জানতাম যে তাঁরা সত্তুর দশকের গোড়ার দিকে আগারগাঁ-র সরকারি কলোনির মাঠে বসে বসে আড্ডা দিতেন। কলোনির বি¯-ৃতির কারণে সে মাঠটা এখন সংকুচিত হয়ে পড়েছে।সেটা ছিল ১৯৭৯ সাল। পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তরুণ কর্মকর্তারা অনেকেই তখন আগারগাঁ সরকারি কলোনিতে সাবলেট থাকতেন। খোরশেদ আলমও সাবলেট থাকতেন। কলোনির মাঠটা তখন অনেক বড়। সন্ধ্যার দিকে সেখানে খোরশেদ আলম আড্ডা দিতেন তাঁর বন্ধুদের সাথে। ১৯৭৯ সালের কোনো এক সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে কর্মরত শহীদুল জহির আগারগাঁ কলোনির মাঠে আড্ডা দিতে এসেছিলেন।

তখন তিঁনি তাঁদের মগবাজার নয়াটোলার বাসাতেই থাকতেন। খোরশেদ আলমের সাথে শহীদুল জহিরের প্রথম দেখাটি তেমন অর্থবহ কিছু ছিল না। তরুণদের এই গ্র"পটিই আবার অফিসেও আড্ডা দিত। এভাবেই খোরশেদ আলম আবিস্কার করেন যে শহীদুল জহির একজন লেখক। খোরশেদ আলম তখন আইসাক সিঙ্গারের লেখায় ডুবে আছেন। আইসাক সিঙ্গারের সাহিত্যকর্ম এবং সমকালীন বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁদের আলাপচারিতা শুরু হয়। সেই থেকে ঘনিষ্ঠতারও শুরু। তারপর আড্ডার বিষয়ে ঢুকে পড়ে রাজনীতি ও অর্থনীতি। কিš' শহীদুল জহির নারী বিষয়ক আলোচনায় তেমন একটা ঢুকতেন না।আমরা দেখি, ১৯৮৫তে শহীদুল জহিরের প্রথম গ্রন্থ 'পারাপার' বের হয়েছে। খোরশেদ আলম 'পারাপার'-এর গল্পগুলো মনোযোগ দিয়েই পড়েছিলেন। সে সময়ে আমরা দেখি, খোরশেদ আলমের সাথে শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করছেন; তাঁদের ভেতরে তর্ক-বিতর্কও চলছে।তারপর আমরা দেখি, ১৯৮৭ সালে দৈনিক সংবাদ-এ খোরশেদ আলম আইসাক সিঙ্গারের একটি গল্প অনুবাদ করেন 'ফেরা' নামে। শহীদুল জহির তখন দৈনিক সংবাদের কপি নিয়ে ঢুকছেন পরিকল্পনা কমিশনের খোরশেদ আলমের রুমে; ঢুকেই বলছেন-বিরাট কাজ করেছ! এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন তিনি! তারপর অফিস শেষে তারা দু'জন হাঁটছেন এখনকার রোকেয়া সরণী ধরে শেওড়াপাড়ায় খোরশেদ আলমের বাসার দিকে। শহীদুল জহির তখন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্প অনুবাদ করছেন। কিছু অনুবাদ সম্ভবত দৈনিক সংবাদ-এ ছাপা হয়। শহীদুল জহির তখন আগারগাঁ কলোনি ছেড়ে গ্রীন রোডের গেজেটেড অফিসার্স কলোনিতে উঠে গেছেন যেখানে অবিবাহিত সরকারী কর্মকর্তারা সাধারণত থাকেন। ১৯৮৫-৮৭ পর্যš- আগারগাঁ কলোনির ৪০৩ নম্বর বাসাতে তিনি থেকেছেন। সে বাসাটি ছিল তাঁর সহকর্মী বন্ধু হাবিবের নামে। হাবিবুর রহমান একাই থাকতেন সে বাসাতে। তিনি শহীদুল জহির-কে সে বাসায় থাকার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। আগারগাঁ কলোনি থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের দূরত্ব খুব কম ছিল বলে শহীদুল জহিরের অফিসে আসা-যাওয়া করতে সুবিধা হয়েছিল।এখানেই লিখা হয় তাঁর ছোটগল্প 'আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই'।১৯৮৯ সালে সেবা প্রকাশনী থেকে খোরশেদ আলমের আইসাক সিঙ্গারের অনুবাদ গ্রন্থ বের হয়। সে উপলক্ষে মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের কোনার মাঠে (যে মাঠটা এখন আর নেই) তিনি একটি পার্টি দেন। সেখানে খোরশেদ আলমের অনেক ইয়ারের ভেতরে শহীদুল জহিরও ছিলেন। বিহারি ক্যাম্পের সে মাঠে তখন খোরশেদ আলম নিয়মিত আড্ডা মারতে যেতেন। শহীদুল জহির সেখানে একবারই গিয়েছিলেন মাত্র। একই সময়ে শহীদুল জহির তাঁর দ্বিতীয় বই 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা'-র একটি কপি খোরশেদ আলম-কে উপহার দেন। খোরশেদ আলম চমৎকৃত হয়েছিলেন গল্প পড়ে। তাঁর মনে হয়েছিল, 'পারাপার'-এর শহীদুল জহিরের সাথে 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা'-র শহীদুল জহিরের বি¯-র পার্থক্য - গল্পের বিষয়ে পার্থক্য, কাঠামোতে পার্থক্য, গল্পের বুননে পার্থক্য, ভাষায় পার্থক্য আর পার্থক্য মানবিক আবেদনে। তিনি শহীদুল জহিরকে বলেছিলেন - তোমার গল্প বলার ভঙ্গিটা বদলাতে পার। গল্পটা এমনভাবে বলছ, যেন তুমি দূর থেকে ঘটনাগুলো দেখছ এবং আমাদেরকে তা শোনাচ্ছ।
শহীদুল জহির কোনো বাহাস করেননি। তিনি খোরশেদ আলমকে জানিয়েছিলেন যে গল্পটা জাদুবা¯-বতার ঢঙে লেখা। আলাপ এর চাইতে আর আগায়নি। আজকের খোরশেদ আলম বলেন - জাদুবা¯-বতার কাঠামোতে শহীদ যে এত জাদু লাগিয়ে দেবে, তা তখন আমি ভাবিনি!এভাবে আমরা দেখি, দু'জন সাহিত্যিকের ভেতরে গড়ে উঠছে বন্ধুত্ব। ১৯৯১ সালে শহীদুল জহির খোরশেদ আলমের তাজমহল রোডের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছেন (উল্লেখ্য, শহীদুল জহির সচরাচার কারো বাসাতে যেতেন না)। আরো দেখি, ১৯৯২ সালে হিউবার্ট হামফ্রে ফেলোশিপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরের জন্য যাওয়ার আগে শহীদুল জহির তাঁর গ্রীন রোড কলোনির ২/১০ নম্বর বাসাতে নিমন্ত্রণ করছেন বন্ধু খোরশেদ আলম-কে। তারপর ১৯৯৩ তে আমেরিকা থেকে ফেরার পর সম্ভবত শহীদুল জহিরের পোস্টিং হয় সাভারের পিএটিসি-তে। মাঝখানে প্রায় বছর তিনেক এ দু'লেখকের মাঝে যোগাযোগ কমে যায় যেহেতু শহীদুল জহির তখন পরিকল্পনা কমিশন চত্বরের বাইরে ছিলেন। সম্ভবত ১৯৯৭ সালের দিকের কোন সময়ে শহীদুল জহির বদলি হয়ে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে, যেখানে সবুজ আর সবুজ-জড়াজড়ি করে আছে ইউক্যালিপটাস, বকুল গাছ, ঝাঁকড়া কাঠবাদাম, আমগাছ, কড়-ই, অনেক লাল রঙ্গন আর ঘাসের স্ট্রিপ। আবার নিয়মিত আড্ডা শুরু হয় দুই বন্ধুর (১৯৯৪ সালে শহীদুল জহিরের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। ১৯৯৭ সালে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে ফিরে আসার পর তিনি তাঁর বন্ধু খোরশেদ আলমের মাধ্যমে আমাকে খুঁজে বের করেন। আমি তখন পরিকল্পনা কমিশনে খোরশেদ আলমের পাশের রুমে বসি)। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত শহীদুল জহিরের উপন্যাস 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' তখন আমরা পাঠ করি। 'আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস' ততদিনে পড়া হয়ে গেছে। তার গল্প আমাদেরকে আরো মুগ্ধ করে।১৯৯৭ সালে এ শহীদুল জহির ও খোরশেদ আলমের সখ্যের ১৮ বছর হয়ে গেছে। আমি দেখি, শহীদুল জহির প্রায়ই আড্ডা দিতে আসছেন খোরশেদ আলমের সাথে। শহীদুল জহিরের অফিসরুমে খোরশেদ আলম তেমন একটা যান নাআলসেমির কারণে। তাঁদের দু'জনের ভেতরে আবারো বাংলা সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলছে। তাঁদের আড্ডায় তখন আমিও যোগ দিতে শুরু করি। এ সময়ে শহীদুল জহির লিখছেন 'ধূলোর দিনে ফেরা' আর 'চতুর্থ মাত্রা'-র মতো অসাধারণ গল্প। গল্পগুলো তিনি পড়তে দিচ্ছেন বন্ধু খোরশেদ আলম-কে। আমিও পড়ছি। ১৯৯৯ তে তাঁর 'ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প' প্রাকাশিত হলে আমরা আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুলো ডিসেকশন করেছিলাম বলেই মনে পড়ছে।
১৯৯৭ থেকে মোটামুটিভাবে ২০০৫ পর্যš- এ দু'লেখকের ভেতরে চমৎকার মনোজাগতিক লেনদেন ছিল। ২০০৫-এর পরে দেখা গেল, শহীদুল জহির তাঁর অফিসরুম থেকে বেরিয়ে খুব একটা কোথাও আড্ডা দিতে যাচ্ছেন না। দেখেছি ২০০৬ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যš- শহীদুল জহির নিজেকে তাঁর অফিসরুমে একরকম বন্দী করে ফেলছেন। আড্ডা কমে যাওয়ার কারণে শহীদুল জহিরের 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প' ও 'মুখের দিকে দেখি' বই দু'টি নিয়ে খোরশেদ আলমের সাথে তাঁর দীর্ঘ সংলাপ হয়নি বলে জানা যায়।প্রায় তিন যুগের সখ্য লেখক শহীদুল জহির এবং লেখক খোরশেদ আলমের। ২০০৪ এ 'রোববারে'-এ খোরশেদ আলমের একটি উপন্যাস ছাপা হয়। উপন্যাসটির নাম 'এক তাগড়া জোয়ানের যুবতি বউ হারানোর কেচ্ছা'। এ নামটি নিয়ে শহীদুল জহির এবং আমি অনেক মশকরা করেছিলাম এবং আমরা নারী বিষয়ক রসালো আলোচনায় মত্ত হয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য এবং আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এ পৃথিবীর কোনো নারীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। তবে ফ্যান্টাসি? ফ্যান্টাসি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।শহীদুল জহিরের গল্প বলতে বলতে লেখক খোরশেদ আলম এখানেই থেমে যান। আর কোনো জরুরি ইতিহাস তাঁর বলার নাই।খোরশেদ আলম-কে আমি প্রশ্ন করি - ব্যক্তি শহীদুল জহির সম্পর্কে কিছু বলুন।কিছু বলেনও তিনি। তাঁর কথার সারাংশটি এমন : প্রয়াত শহীদুল জহির এত বড় লেখক হয়েও খুব সাধারণ মানুষের ক্যামোফা¬জে থেকেছেন সব সময়। সব সময়ই তিনি ভাবের গভীর জগতে থাকতেন। লিখালিখির ব্যাপারে বরাবরই খুব ফোকাস্ড ছিলেন শহীদুল জহির। লেখক হিসাবে এ পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথেই তিনি সমঝোতা করেননি কখনো। তিনি নিজের মনে লিখতেন। পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের কোনো দায় তিনি অনুভব করেননি। তাই তিনি এক কলম লিখে দীর্ঘদিন বসে বসে ভাবতে পারতেন। তিনি মনে করতেন, তার যেমন ভাল লেখার অধিকার আছে, তেমনই আছে খারাপ লেখার অধিকার। যা ইচ্ছা তাই-ই লিখতে পারেন একজন লেখক। কোনো পত্রিকার সম্পাদক যদি তা না ছাপান, তা'তে কিছু যায় আসে না। আর লেখকদের দলাদলির ভেতরে কখনোই ঢুকতে চাননি শহীদুল জহির। তিনি নির্জন এক দ্বীপ। কোলাহল থেকে দুরে থেকে লিখতে চেষ্টা করেছেন মানসম্মত গল্প আর উপন্যাস।খোরশেদ আলম বলেন - সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে শহীদুল জহিরের একনিষ্ঠতা অতুলনীয়। কিš' শহীদুল জহির তাঁর নিজের জীবনকে এতখানি নিরস না বানালেও পারতেন! নারীসঙ্গ যে সবসময় কাউন্টার প্রোডাক্টিভ হবে - এমনটি ভাবার কোনো কারণ নাই। স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া শহীদুল জহিরের একাকী জীবনের যেসব বিবিধ ভার জমেছিল, মানুষজনের সাথে মন খুলে মিশলে হয়ত তা কমে আসত! শহীদুল জহিরকে খোরশেদ আলম বলেছিলেন -একজন বৈরাগীর জীবনেও তো ব্যক্তিগত ভার লাঘবের সুযোগ থাকে, যেমন আর কিছু না হোক, ক্লাšি-, অবসাদ আর একঘেঁয়েমি কাটাতে একজন বৈরাগী নতুন কোনো লোকালয়ে চলে যেতে পারে বা নাচ-গান করতে পারে অথবা গাঁজা খেতে পারে। শহীদুল জহির তাঁর নিজের তৈরি করা নিরস জীবনযাপনে একটু হলেও আলো-বাতাস আসতে দিয়ে দেখতে পারতেন। খোরশেদ আলমকে শহীদুল জহির নিজেই জানিয়েছিলেন যে ব্যক্তি জীবনে তিনি মোটেই সাহসি মানুষ ন'ন। কাজেই একা থাকার ভার কমানোর জন্য তাঁর পক্ষে আর যাই হোক, বিপ্লব করাটা ভয়ানক কঠিন। আর সে জন্যই নিজের জীবনযাপনের ভারটুকু, বিষটুকু তাঁকেই গলধঃকরণ করে নীলকণ্ঠি হতে হয়েছে বলে খোরশেদ আলমের ধারণা। শহীদুল জহিরের নিরস জীবনযাপনের কোনো প্রয়োজন দেখেননি খোরশেদ আলম ।
কিš' কেন শহীদুল জহির এ নিরস জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন? সেটা কি নিরবিচ্ছিন্ন সাহিত্যসৃষ্টির জন্য? নাকি কোনো নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয়েছিল হƒদয়? সে খবর আরো অনেকের মতই খোরশেদ আলমও জানেন না।খোরশেদ আলম বলেন - শহীদ আমার এত কাছের বন্ধু, কিš' অনেক ব্যক্তিগত বিষয় সে কখনোই আমার সাথে শেয়ার করেনি। ঘনিষ্ঠ হলো না শহীদ! বহুত চেষ্টা করলাম! কাছাকাছি থাকলাম, চল্লাম পাশাপাশি তিরিশ বছর মতো, কিš' মনে হয় সত্যিই তাকে আমি পুরোপুরি চিনতে পরিনি।তবে কি শহীদুল জহিরের তীব্র কোনো অভিমান ছিল? অনতিক্রম্য ক্ষোভ ছিল কোনো? অনেক চেষ্টাতেও শহীদুল জহিরের কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর বের করা যায়নি বলে খোরশেদ আলম জানান। শহীদুল জহির সযতনে তাঁর একাকী জীবনযাপনের কারণ এবং ইতিহাস সম্পর্কে আমাদেরকে কোনো সূত্র দিয়ে যাননি। খোরশেদ আলম যেমন সাহস করে বন্ধু শহীদুল জহিরকে এ একাš- ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্নটি করতে পেরেছিলেন, পরিচিত বেশির ভাগ মানুষই শহীদুল জহিরকে এ প্রশ্নটি করেছিলেন নিশ্চয়। সেটাই স্বাভাবিক, কেননা আমরা মানুষেরা কোনো একটি ঘটনার কার্যকারণ খুঁজি; যতক্ষণ কার্যকারণ খুঁজে না পাই, আমরা অস্ব¯ি-তে ভুগতে থাকি।খোরশেদ আলম আরো বলেন- বন্ধুত্বের একটা সহজ পর্যায়ের পর শহীদুল জহির মানুষের সাথে সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তুলে দিতেন, যে দেয়াল কখনো ভাঙা যেত না; দেয়াল ভেঙে পৌঁছানো যেত না তাঁর আত্মার খুব কাছাকাছি। এই বলেই খোরশেদ আলম শহীদুল জহিরকে নিয়ে তার গল্প শেষ করেন।

No comments: