Friday, April 11, 2008

জীবন-বাস্তবতা

সুশা¯¦ মজুমদার
___

শহীদুল জহিরের অকাল প্রয়াণ প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের জন্যে বিশাল এক ক্ষতি। নিভৃতে সাহিত্যের বাঁক বদলে দেয়া নীরবচারী এই শব্দশিল্পীকে যুগাš-রের শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং ভালোবাসা
লেখকদের জানাশোনা প্রিয় অঞ্চল থাকে যেখানে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে স্বীয় লেখার জন্য রসদ আহরণ করেন। সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরী, শওকত আলীর দিনাজপুরসহ উত্তর বাংলা, হাসান আজিজুল হকের রাঢ়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুরনো ঢাকা, অলিগলি, তার ভেতরে দমবন্ধ চাপা অন্ধকারের সুড়ঙ্গ থাকলেও তিনি ঢুকে পড়েছেন। সদ্য প্রয়াত শহীদুল জহির লক্ষ্মীবাজার, ওয়ারি, নারিন্দা, ভূতেরগলি, আগারগাঁও মহল্লা লাগোয়া মহল্লা, তার আশপাশের বিশদ চালচিত্র তার সাহিত্যের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ এ অঞ্চলসমূহ লেখকের গল্প-উপন্যাস থেকে বেরিয়ে গোটা দেশের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। খণ্ড খণ্ড এলাকা হয়েছে অসংখ্য ভূমিÑ বিশাল বাংলার সমান। এখানকার পশ্চাদভূমি ও তার আখ্যান মানুষের শরিক হওয়ায় পাঠকের নিজেরও বিষয় হয়ে আগ্রহের কারণ হয়। লেখকের পরিচিত নির্দিষ্ট এলাকা শিল্পে চিত্রিত হতে যদি জখম বা দুর্বল হতো তার পরিণতি গিয়ে দাঁড়াত সে ফ আঞ্চলিক পাঁচালি। শহীদুল জহির নিভৃতচারী কিš' অনুসন্ধানী, কোলাহলবিমুখ কিš' প্রাণাবেগ ও জীবনের চাঞ্চল্য প্রকাশে দৃঢ় ও দক্ষ। সংঘবিচ্ছিন্ন কিš' প্রভাববি¯-ারকারীÑ ক্রমশ মনস্ক হƒদয়সংবাদী পাঠকের ধন্য লেখক হয়ে উঠছিলেন। জানা মতে, শহীদুল জহিরের সাহিত্যচর্চার সময়সীমা প্রায় ত্রিশ বছর। এই সময়ে তিনি লিখেছেন কম, পড়েছেন বেশি। খোঁজাখুঁজি করলে এমনও দেখা যেতে পারে তার অপ্রকাশিত ও অসম্পূর্ণ লেখা বাতিল কাগজের ¯-ূপে হেলাফেলায় রেখে গেছেন। নিঃশব্দে নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে তিনি প্র¯'ত করেছেন। ওই যে আপ্তবাক্য, সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বালাতে হলে দিনে সলতে পাকাতে হয়। নি¯-ারহীন অতৃপ্তি লেখককে একটি লেখা থেকে আরেকটি লেখার জন্য প্ররোচিত করে। এখানে কোন কোন লেখক ধৈর্য ও নিজস্ব অধ্যবসায় নিয়ে লেখা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করেন। একই সঙ্গে নিজের লেখার পোস্টমর্টেম করেন। শহীদুল জহির ছিলেন এমন বিরল গোত্রের লেখক। এর উদাহরণ তার 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা', 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল', 'মুখের দিকে দেখি', 'ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প', 'ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প' উপন্যাস, গল্পগ্রন্থসমূহ। বিষয় নির্বাচনে তিনি ব্যতিক্রম এবং সাবধানী। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে শহীদুল জহির নিশ্চিত উজ্জ্বল নাম যার পাঠ তৃষ্ণা ছিল বিশ্বব্যাপী, ভুবনডাঙ্গা থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজের সাহিত্যের স্বতন্ত্র চারা রোপণ করেছিলেন স্বভূমিতে। স্বদেশের চৌহদ্দিতে ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা মেলে নিজে হয়ে উঠেছিলেন একজন দ্যুতিময় লেখক।
শহীদুল জহির বা¯-ববাদী লেখক। তিনি লাতিন আমেরিকার জাদুবা¯-বতার ধারারও লেখক। দুইয়ের যাই হোন, কাহিনীতে জালের পর জাল সৃষ্টি করলেও, তার গণ্য অবা¯-ব, স্বপ্নালু জগৎসহ তাবৎ লেখার শেকড় বা¯-বতা ছিঁড়ে আলাদা হয়নি। চরিত্র দেখার, দেখানোর জন্য পায়ের নিচে যে ভিত রেখে তিনি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার সারাৎসার দ্বারা আলোড়িত হয়ে নিজের জন্য বিশ্লেষণ তৈরি করেন অংশত এটা মার্কসবাদের আলোয় তৈরি। অংশত মানে ধ্র"পদী মার্কসবাদের জোরালো তত্ত্বেও তিনি আবৃত বা অভিভূত নন। তার দৃষ্টিভঙ্গি বরং সফিসটিকেটেড মার্কসবাদীর। এই অভিধা তাকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না। লেখার মধ্য দিয়ে লেখক জীবনবীক্ষা ছড়িয়ে দিয়ে যান। কারও লেখায় তা প্রত্যক্ষ, কারও লেখায় তা মৃদু, থেকে যায় পরোক্ষ। মানুষ ও বা¯-বতা, বা¯-বতার আড়ালে থাকা বা¯-বতা সন্ধানে ও সন্ধানকালে শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্যের অš-ঃ¯-লে বিরাজ করে অর্থবোধক শক্তির সন্ধান। বিষয়টি মেধাবী পাঠকের জন্য অনুভবের ও বিবেচনার। ছক বাঁধা নিজস্ব আইডিয়া বা চরিত্রের তৎপরতার মধ্য দিয়ে তার দার্শনিকতা ধারণ করে বিষয় ও চরিত্র দুই-ই অযথা ভারি হয়ে যায় না। কোথাও তারা সুতোয় বাঁধা পড়েন। লেখকের প্রকাশ্য বা গোপন ইচ্ছা জিতিয়ে দেয়ার জন্য গল্প-উপন্যাসের চরিত্র পুতুল হয়ে যায় না। এ কাজটি তখুনি সম্ভব লেখক যখন পরিমিতবোধ ও নির্লিপ্তির মাত্রা যোগ্য হাতে মোকাবেলা করতে পারেন। 'পারাপার', 'ডলু নদীর হাওয়া', 'ডুমুর খেকো মানুষ' গল্পগ্রন্থ এবং 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা' উপন্যাস তার প্রমাণ। শহীদুল জহিরের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, 'আমার লেখা মার্কসবাদে আচ্ছন্ন ছিল। এখনও সেটা আছে। প্রতিবাদী ভঙ্গি থেকে আমি সরে এসেছি। ওখান থেকে সরে আসা মুশকিল।' (প্রকাশিত সাক্ষাৎকার/আরকে রনি)। না, মার্কসীয় দর্শন নিয়ে তিনি মোটা দাগের বা উচ্চকিত সাহিত্য করেননি। তার প্রতিবাদী ভঙ্গি কখনোই প্রখর, তীব্র, তীক্ষè যার একটাই অর্থ চড়া তা নয়। মার্কসীয় চিš-ার পলিশড ফরমের প্রলেপ বরং সাহিত্যে দেখা যায়। গল্পের বিষয় থেকে বিষয়াš-রে যেতে তাই সুবিধা হয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন রকম পরিণতির সম্ভাবনা তৈরি করে বলে পাঠক থেকে পাঠকে শহীদুল জহিরের লেখার অর্থ আবিষ্কার হয় বিভিন্ন। শহীদুল জহিরের 'জীবন ও রাজনৈতিক বা¯-বতা' উপন্যাস যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ হলেও এর সূত্রপাত ঘটে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রে রেখে। 'বদু মওলানার একাত্তরের প্রথম দিককার চেহারার টানাপোড়েন পঁচিশে মার্চের পর কেমন প্রশাš- হয়ে আসে এবং মহল্লায় যেদিন প্রথম মিলিটারি আসে সেদিন সে কিভাবে আবিষ্কৃত হয়। মহল্লার লোকেরা সেদিন মাত্র এক ঘণ্টার প্রলয়ের পর বুঝতে পারে তার বিশেষ মর্যাদার কথা।' উপন্যাসে এমন ইঙ্গিতই একজন পাকি¯-ানি দালাল চরিত্রের জন্য যথেষ্ট। বিকেলে বদু মওলানা মহল্লার আকাশে কাক ওড়াত। কাকের উদ্দেশে যে মাংসের টুকরোগুলো ছুড়ে দিত সেগুলো ছিল মানুষের মাংস। মানুষের শরীরের টুকরো টুকরো অংশের যে বর্ণনা এই উপন্যাসে শহীদুল জহির দিয়েছেন তা পড়তে গিয়ে পাঠকের øায়ু ও শিল্পের সংযম প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। আবার তিনি আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন প্রসঙ্গাš-রে সরে গিয়ে। একাত্তরের নিষ্ঠুর বা¯-বতা তুলে তিনি কি পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা করেন? একবার অতীত একবার বর্তমানÑ একই সঙ্গে উভয় সময়কে ভ্রমণ করিয়ে গেঁথে তুলেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা। আমরা নরঘাতক বদু মওলানা সম্পর্কে জানতে পারি : 'বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া বিষয়ক তার যে দুর্যোগ হয় সেই অবস্থার ভেতর দিয়ে পার করে নিয়ে আসে এবং আশি সনে সেই একই দলের বড় নেতা হয়। আবদুল মজিদ এখন দেখে আজিজ পাঠানদের সঙ্গে বদু মওলানার দল একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে।' আমরা বা¯-বেই দেখতে পাচ্ছি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যায্য একাধিক পরিবর্তনের সুযোগে যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয়েছে। আবার তারা শক্তি পেয়েছে। শহীদুল জহিরের এ উপন্যাসটি ছোট হলেও তলদেশস্পর্শী। পুরনো ঢাকার মহল্লাভিত্তিক ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ দেশের সমকালীন দুর্দশা।
মেঘহীন পূর্ণিমা রাতে সুহাসিনী গ্রামের মফিজুদ্দিন মিয়ার সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা জানিয়ে শুরু হয় শহীদুল জহিরের 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' উপন্যাস। বারবার আসে ভাদ্র মাসের অতিকায় চাঁদ, পূর্ণিমার চন্দ্রালোকিত রাত। মফিজুদ্দিন জš§গ্রহণও করে 'পূর্ণিমার চাঁদটি যখন পরিপূর্ণ অনাবৃত।' 'সুহাসিনীর লোকেরা পরে জানতে পারে যে, আকালুর বোবা স্ত্রী খুব কষ্টের পর একটি ছেলে সš-ানের জš§ দেয় এবং ছেলেটি জšে§র সেই একটি মুহূর্তে কুঁড়েঘরের দুয়ারে বসে প্রতীক্ষারত আকালু ঘরের ভেতর থেকে নবজাতকের চিৎকার শোনে এবং তখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একচিলতে জ্যোৎøা তার পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে।' উপন্যাসে অসংখ্যবার চাঁদ-জ্যোৎøা-ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার উপস্থিতি দারুণ জমাট এক রহস্য তৈরি করে। সেই রহস্যের মধ্যে মফিজুদ্দিনের উত্থান এবং 'ধ্বংস¯-ূপের ভেতর মৃতদেহের সঙ্গে তাদের স্মৃতির সম্ভাব্য সাক্ষীগুলোও' পাঠক পেতে থাকে। তোরাপ আলী এখানে কথক। তার বয়ানের মধ্য দিয়ে দীন কৃষকের ছেলে মফিজুদ্দিনের বেড়ে ওঠা। এলাকার মর্যাদাশীল মিয়াবাড়ির মেয়ে চন্দ্রাভানকে বিয়ে করা। এগারো সš-ানের পিতা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার ঘটনাবলী জানা যায়। কাহিনীর পরতে পরতে রহস্য থাকলেও তা ভেঙে আমরা জনতে পারি পাড়াগাঁর দুরবস্থা, ভাঙা-গড়া, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র, ভালোবাসা। নারী লিপ্সা ও বিরামমহীন যৌনকর্ম।শহীদুল জহির লাতিন আমেরিকার জাদুবা¯-বতার ভাবশিষ্য। গার্বিয়েল মার্কেজের উপন্যাস পড়ে তিনি আলাদা এক টেকনিকের সন্ধান পান। ওই টেকনিকে 'সে রাতে পূর্ণিমা ছিল' রচিত। জাদুবা¯-বতা ওই মহাদেশের সাহিত্যে নতুন কোন বিষয় নয়। কথাসাহিত্যে জাদুবা¯-বতা যখন আš-র্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়, গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল পুরস্কার পান তখন এটা তুমুল আলোচিত হতে থাকে। পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকায় পৌনঃপুনিকভাবে বারো হাতে চটকানো কাহিনী নতুন আবেদন ও বিষয় ধাবণে অক্ষম হয়ে পড়ে। তাদের সাহিত্যের শূন্যগর্ভ করুণ অবস্থার কারণে সাহিত্যবোদ্ধারা মনোনিবেশ করেন লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্যে। পেছন ফিরে দেখা যায়, দেশভাগের পর ষাটের দশকে ঢাকায় যে কোন সময়ের চেয়ে ইউরোপীয় সাহিত্যের বই বেশি পাওয়া যেত। এই সাহিত্যের পঠন-অভিজ্ঞতা আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করে। কিš' কেবল পু¯-কী অনুভব দিয়ে নিজস্ব সাহিত্য রচনা করা যায় না। পরের কথা ও লিপিকৌশল নিজের মতো করে গড়ে তোলা না গেলে তা আয়ুষ্মান সাহিত্যের মর্যাদা পায় না। ষাটের দশকের সেসব কবি-সাহিত্যিকের অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। কেউ কেউ এখনও সক্রিয় থাকলেও আগের ধারা থেকে সরে এসেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আশির দশকে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের সাহিত্যের বই বেশি বেশি পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকার দেশ থেকে দেশে ভৌগোলিক- রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, বহু সীমাš- থাকলেও স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা, লোককথা, পুরাণ, কিংবদšি-, ওই মহাদেশের ঐতিহাসিক চরিত্র। বীরপুরুষরা প্রাক শিল্পায়ত দেশগুলোর জন্য এক অখণ্ড শিল্প-সাহিত্যের উপকরণ। লাতিন আমেরিকার লাইফমোটিফ নিয়ে অন্যরকম রাজনীতি নিয়ে লেখকরা সৃষ্টি করেন তথ্যময় সব উপন্যাস। জাদুবা¯-বতা প্রকৃতপক্ষে আর কঠিন এবং মাটি থেকে ছেঁকে তোলা বা¯-ব। কেবল সাহিত্য রচনার জন্য, পাঠককে মহাদেশের ভেতর কাঠামোর ভাষ্য জানানোর জন্য চাই প্রচলিত ভাষাতন্ত্রকে ভেঙে ফেলা যা শাসকদের বাসনা এবং সমাজের উপর মহলের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-বিধিনিষেধ হয়ে আছে। এমন মহৎ কর্ম মার্কেজের আগে আলেহে কার্পেšি-য়ের, আনহেল আ¯'রিয়াস, হুয়ান রুলফো'সহ অনেক সমাজলগ্ন সচেতন লেখক উপলব্ধি করেছিলেন। আমাদের সমকালীন কথাসাহিত্যে শহীদুল জহির জাদুবা¯-বতার পরিশ্রমের কাজটি করে চলেছিলেন। তার গল্প-উপন্যাস পড়ে ধারণা হয়, শহীদুল জহির বুঝি মনে করতেন, তার আখ্যানের দুর্ধর্ষ উপস্থিতিকে ফুটিয়ে তুলতে হলে আখ্যায়িকা তৈরির যে রীতিনীতি কৃৎকৌশল ভাষাব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে খাড়া করা হয়েছে তার সবকিছুকেই ভেঙে ফেলতে হবে। এ কারণে নীরবতা দিয়ে তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। শহীদুল জহির প্রচার-প্রপাগান্ডা থেকে দূর থাকলেও, আমাদের পরনির্ভরশীল আপসকামী স্টাবলিশমেন্ট তার সাহিত্যকে কদর না করলেও ধীরে ধীরে তিনি আরও পরিণত, আরও ক্ষমতাবান লেখক হয়ে উঠছিলেন। শুরুর দিকে তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন। ক্রমে ক্রমে তার লেখার ধরন, বিষয় বুননের মুগ্ধতা নিয়ে এ-কালের নবীন লেখকদের সমাবেশ দেখা যায়। অবশ্যই এটা ইতিবাচক দিক।
শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাসের বাক্য দীর্ঘ। বিষয় নির্মাণে, চরিত্র চিত্রণে, রূপকল্প সৃৃষ্টিতে তার মনোভাবনা যতক্ষণ পুরোপুরি ধরা না পড়ছে, বাক্য তিনি তৈরি করে যাচ্ছেন। এ কারণে তার গল্প-উপন্যাসের বাক্য কখনও গভীর হলেও বুনোট মোলায়েম নয়। প্রশ্ন হতে পারে, তিনি কি পাঠককে তার লেখায় প্রবেশ-পথ দিতে ইচ্ছুক নন। শহীদুল জহির উদ্যোগী নিয়ত যতœশীল পাঠকের নিñিদ্র মনোনিবেশ কামনা করেন। সময় খরচের সময় আছে এমন মজা-সন্ধানী পাঠক তার পাঠক হতে পারেন না। গভীর একাগ্রতা দিয়ে তার আখ্যানের অর্থোদ্ধার করতে হয়। এখানেই বারোয়ারি লেখকদের সঙ্গে শহীদুল জহিরের পার্থক্য। দেশের তিন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আত্তীকরণ করলেও শহীদুল জহির নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে নিষ্ঠাবান ছিলেন। তার প্রয়াস ছিল ঐতিহ্যকে খারিজ করে নয়, বরং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিত জীবনকাল নতুনভাবে নির্ণয় করা। ভুঁইফোড় সাহিত্য বলে কিছু নেই। মুক্তিপ্রয়াসী সাহিত্য প্রথাগত সাহিত্যে আস্থা না রাখলেও পূর্ববর্তী ধারাকে বাতিল করে দেয় না। রুটলেস সাহিত্য বলে যদি কিছু থাকে তবে তা খণ্ডকালীন দুরূহতা সৃষ্টি করে নিঃশেষ হতে বাধ্য। শহীদুল জহিরের টান টান গদ্য রচনায়, বিষয়ানুযায়ী ও চরিত্রানুযায়ী ডায়লগ লেখায়, গ্রামীণ পটভূমি নির্মাণে, উইট-হিউমার প্রকাশে, এমনকি স্বাভাবিক স্ল্যাং ব্যবহারে উল্লিখিত তিন জ্যেষ্ঠ লেখককে মনে করিয়ে দেয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ব্যবহার করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চরিত্রকে ঝাঁজরা করে ফেলেছেন। রূঢ় বা¯-বতা ধরতে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ ও আপসহীন। শহীদুল জহির অত নির্মম নন। বরং দয়া-মায়ার অংশে চরিত্ররা ভাগ পায়। বিষয় বদলে গেলে পরিবর্তিত ধ্যান-ধারণার জন্য নতুন কলাকৌশল বা আঙ্গিক অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। লেখকের এখানে আলাদা কসরতের প্রয়োজন পড়ে না। গল্প-উপন্যাস উত্তীর্ণ সাহিত্যের মর্যাদা পেলে কি গদ্য কি আঙ্গিক সব সফলভাবে বিরাজ করে যা শহীদুল জহিরের স্বকীয় প্রতিভাদীপ্ত কর্মের মধ্যে আমরা পেয়েছি।এই প্রথম স্বাধীনতা-উত্তর আশির দশকে আবির্ভূত ও বিকশিত একজন শক্তিমান সর্বাংশে আধুনিক কথাসাহিত্যিকের প্রকৃতই অকাল প্রয়াণ ঘটেছে।

No comments: