Thursday, May 8, 2008

বনলতা সেনের খোঁজে

বাংলার মুখ
বনলতা সেনের খোঁজে
কে এম আব্দুস সালাম
_____________

প্রকাশের পর থেকেই বনলতা সেনকে নিয়ে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় সাকল্যে তিনবার বনলতা সেনের নাম নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তারমধ্যে দুবার সরাসরি ইঙ্গিত করেছেন বনলতা সেনের আবাসভুমি বাংলাদেশের নাটোর। কে এই নারী? কী তার পরিচয়? বনলতা সেন নামের কোনো মেয়ের সঙ্গে কি জীবনানন্দ দাশের আদৌ পরিচয় ছিল? তার চেয়ে বড় কথা কবি কি কখনো নাটোরে পদার্পণ করেছিলেন? বনলতা সেন বইটি হাতে নিয়ে গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন, এই বনলতা সেনটা কে? এই নামে সত্যি আপনার পরিচিত কেউ ছিল নাকি?’ প্রশ্ন শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছেন কিন্তু কোনো উত্তর দেননি কবি। বনলতা সেন বিষয়ে আজীবন এই নীরবতা বজায় রেখেছেন কবি, অজান্তেও কখনো কোনো প্রিয়জনের কাছে বনলতার কোনো কাহিনী বর্ণনা করেননি। তবে কবি নীরব থাকলেও গবেষকেরা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি, বনলতা সেনের অন্বেষণে প্রাণান্ত করেছেন। কিন্তু বাস্তব তার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাননি তাঁরা।


জীবনানন্দ দাশ কখনো নাটোরে পদার্পণ করেছিলেন কিনা, এ ব্যাপারেও কোনো তথ্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা। জীবনানন্দ দাশের অন্য লেখায়ও নাটোরে তাঁর আগমন সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে গবেষকদের কাছে বনলতা সেন রয়ে গেছেন এক রহস্যময়ী নারী। তবে গবেষকেরা বনলতা সেনকে রহস্যময়ী মানবী হিসেবে চিত্রিত করলে কী হবে; নাটোরের মানুষের কাছে কিন্তু বনলতা রক্তমাংশের মানুষ, পরম আপনজন। এমনকি তাঁকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে কয়েকটি কাহিনী। যদিও এসব কাহিনী ইতিহাসের কোনো সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়নি। চলুন কাহিনীগুলো শোনা যাক।জীবনানন্দ দাশ একবার ব্যক্তিগত কাজে ট্রেনে করে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। তখন নাটোর হয়ে যেত দার্জিলিং মেল। একাকী কামরায় বসেছিলেন কবি। নাটোর স্টেশনে হঠাৎ অপরূপ সুন্দর একটা মেয়েকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধের নাম ভুবন সেন। তিনি নাটোরের বনেদি সুকুল পরিবারের তারাপদ সুকুলের ম্যানেজার। ভুবন সেনের সঙ্গিনী তাঁরই বিধবা বোন, বনলতা সেন। অচিরেই পথের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন ভুবন সেন। কামরায় জেগে থাকেন শুধু দুজন−জীবনানন্দ দাশ আর বনলতা সেন। এই নীরব মুহুর্তে বনলতা সেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন এমনিতে মুখচোরা কবি। একান্তে একসঙ্গে কেটে যায় বেশ কিছু সময়। একসময় মাঝপথে কোনো এক স্টেশনে নেমে যান বনলতা সেন। কামরায় আবার এক হয়ে যান জীবনানন্দ। বনলতা সেন চলে গেলেন কিন্তু রেখে গেলেন কবির মনে এক বিষণ্নতার ছাপ। তারই অবিস্নরণীয় প্রকাশ নাকি ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।


দ্বিতীয় কাহিনীর কেন্দ্রেও আছেন ভুবন সেনের বিধবা বোন বনলতা। তবে ঘটনাস্থল এবার ট্রেন নয়, ভুবন সেনের বাড়ি। নাটোরে বেড়াতে গেছেন জীবনানন্দ। অতিথি হয়েছেন নাটোরের বনেদি পরিবার সুকুলবাবুর বাড়িতে। এক দুপুরে সুুকুল এস্টেটের ম্যানেজার ভুবন সেনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। ভুবন সেনের বিধবা বোন বনলতা সেনের ওপর পড়েছে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব। খাবারের বিছানায় বসে আছেন জীবনানন্দ। হঠাৎ অবগুন্ঠিত এক বিধবা বালিকা। শ্বেত শুভ্র বসনের চেয়েও অপরূপ এক সৌন্দর্যমন্ডিত মুখ। চমকে উঠলেন কবি। এত অল্প বয়সে বিধবা বসন কবির মনকে আলোড়িত করে। হয়তো সে সময় দু-একটি কথাও হয় কবির সঙ্গে বনলতার। তারপর একসময় নাটোর ছেড়ে যান কবি। সঙ্গে নিয়ে যান এক অপরূপ মুখের ছবি। সেই ছবিই হয়তো কবিকে পথ দেখিয়েছে অন্ধকারে, চারদিকে সমুদ্র সফেনের ভেতরও খুঁজে পেয়েছেন শান্তির পরশ।


তৃতীয় কাহিনীর ঘটনাস্থলও নাটোর। রাজবাড়ির চাকচিক্য তখন ভুবন জোড়া। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানি ভবানী রাজবাড়িতে যে ঐশ্বর্যের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরও সেই সৌকর্যের অনেকটাই ধরে রেখেছিলেন পরবর্তী বংশধররা। কীর্তিমান মানুষদের নিয়মিত আসা-যাওয়ায় তখনও মুখরিত রাজবাড়ি। তাদের আদর-আপ্যায়নের কাহিনীও ছিল কিংবদন্তিতুল্য। এমনই সময়ে নাটোরের কোনো এক রাজার আমন্ত্রণে রাজবাড়িতে বেড়াতে আসেন কবি জীবনানন্দ দাশ। সেখানে দুই দিন অবস্থানও করেন। কবির দেখাশোনার জন্য কজন সুন্দরীকে নিয়োগ করেন রাজা। তাঁদের সেবায় মুগ্ধ হন কবি, একজনের প্রতি জেগে ওঠে আলাদা মমতা। সেই মমত্ববোধ থেকে কবি তাঁকে নিয়ে লিখতে চান কবিতা। লোকলজ্জার ভয়ে শিউরে ওঠে ওই নারী। কবিকে অন্য কোনো নামে কবিতা লিখতে অনুরোধ করেন তিনি। রোমান্টিক কবি তাঁর সেই মানসপ্রিয়ার নাম দেন বনলতা সেন।


এভাবেই কল্পনা ও কাহিনীতে সবার কাছে এক রহস্যময়ী নারীসত্তা হিসেবে চিরঞ্জীব হয়ে আছে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন। আর নাটোর নামটি বাংলা সাহিত্যে হয়ে উঠেছে আর এক বিদর্ভ নগরী।

-

2 comments:

swapon said...

Nice article.Pls keep update.

Unknown said...

Thank you for this article!! I really enjoyed to read this blog post.The information you give will prove to be of great value to me, I hope that. It is our wish that you continue to write great articles in such a future. Thanks for sharing this article.Thanks for sharing the wonderful article