Friday, March 28, 2008

শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

২৩ মার্চ মারা গেছেন শক্তিমান কথাশিল্পী শহীদুল জহির। এই নিভৃতচারী লেখক খুব কমই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় এ বছরের ৪ জানুয়ারি। সাক্ষাৎকারের একাংশ এখানে ছাপা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর কে রনি


__________________________

আর কে রনি: প্রথম লেখা গল্পের কোনো স্নৃতি মনে আছে?
শহীদুল জহির: ‘ভালোবাসা’ নামের একটা গল্প দিয়ে লেখালেখির শুরু। সত্তরের দশকে শহিদুল হক নামে লিখতাম।


রনি: আপনার আশপাশে কেউ লেখালেখি করতেন?
জহির: আশপাশের কারও লেখালেখি তো আসলে বিষয় না। বাবা লেখালেখি করতেন, সেটাও সিরিয়াস কিছু না। আমি কীভাবে লেখা শুরু করলাম, তার কোনো সুত্র নাই। কেন একজন লেখা শুরু করে, আর তার পাশের কেউ লেখে না−এর কোনো নিয়ম নেই।


রনি: আপনি তৈরি হওয়ার সময়টায় কাদের লেখা পড়েছিলেন?
জহির: তখন এত বই ছিল না। লেখালেখিও কম ছিল। প্রথমে পড়েছি বাংলাদেশের লেখকদের: শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক। পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়; বাইরের চেখভ। স্কুলে থাকতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পড়েছি।


রনি: পড়ালেখা কোথায় করেছেন?
জহির: ঢাকাতেই। মাঝখানে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আবার ঢাকায় ফিরে আসি। ইউনিভার্সিটিতে আমার বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।


রনি: ‘ভালোবাসা’ আপনার প্রথম গল্প। আপনার সর্বশেষ গল্প ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ পড়ে মনে হয়েছে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও লেখনভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, এটি আপনার লেখা।
জহির: হতে পারে। তবে আমার লেখায় কাঠামোগত যে পরিবর্তনটা এসেছে, তার শুরু জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে। পারাপার-এর গল্পগুলো অনেকটা গতানুগতিক কাঠামোর।


রনি: কাঠামোর কথা বলছি না, কিন্তু মৌলিকতা একটা আছে।
জহির: মৌলিকতার কথা আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে শেষ যে গল্পটার কথা বলছেন, সেটার সঙ্গে পারাপার-এর লেখাগুলোর একটা মিল হয়তো আছে। আরও দু-একটা লেখা হয়তো আপনি নিতে পারেন, যেমন ‘আমাদের বকুল’। এগুলো আসলে দার্শনিকভাবে এক। সচেতনভাবে আমার কোনো স্টাইল তৈরি হয়নি। স্টাইল তো মানুষের ব্যক্তিত্বেরই অংশ। মৌলিকতা নিয়ে আমি অত চিন্তিতও না। মৌলিকতা স্বীকার করলে বা না করলে কোনো সমস্যা নাই। আমি এমনিই গল্প লিখি। ভাষা যদি আমার তৈরি হয় তো হলো; না হলেও ক্ষতি নাই। কারণ, ভাষা তৈরির জন্য আমি সাহিত্য করি না; লেখার জন্য লিখি।


রনি: গল্প বলায় পূর্ববর্তী কোনো লেখকের শৈলী কি আপনাকে আকর্ষণ করে?
জহির: এটা হতে পারে যে বিভিন্ন গল্প পড়েই মানুষ গল্প বলার শৈলী তৈরি করে। তারপরে নিজের কোনো ভঙ্গি দাঁড়ায় বা দাঁড়ায় না। কাজেই বাংলা সাহিত্যের যে ঐতিহ্য, বিভিন্ন লোকের কাছ থেকেই আমার ভঙ্গি এসে থাকতে পারে।


রনি: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কি এখানে আনতে পারি?
জহির: আমার গল্পের ক্ষেত্রে যেটুকু এসেছে, সেটুকু ওয়ালীউল্লাহ্ ও সৈয়দ শামসুল হকের। গল্প বলায় ক্রিয়ার নিত্যবৃত্ত বর্তমানের যে প্রয়োগ, সেটা এ ধারারই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লেখার এ প্রভাব আমি সৈয়দ হকে দেখি। সেখান থেকেই বিশেষ এ শৈলীটি আমি নিজে দখল করি।


রনি: আপনার গল্পের চরিত্রগুলো কখনো কখনো দার্শনিক হিসেবে আসে−যেমন ‘ভালোবাসা’ বা ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’।
জহির: আসলে অভাবী শ্রেণীর লোকের কথাবার্তা তো, ফলে একই জিনিস। দার্শনিকতা কিছুটা হয়তো আছে। তবে ‘ভালোবাসা’ আর ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ গল্প দুটিকে আমি একই সমান্তরালে রাখতে চাই না। কারণ, দুইটার দার্শনিক ভিত্তি এক। পারাপার-এর গল্পগুলোতে মার্কসীয় একটি ভাবনা কাজ করেছিল। ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ও মনে হয় কিছুটা তা-ই। পরে আমি সেখান থেকে সরে এসেছি। কিন্তু গল্পের চরিত্র বা আবহ তৈরিতে ‘ভালোবাসা’র সঙ্গে ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’-এর একটা বড় পার্থক্য আছে। সেটা হচ্ছে ‘ভালোবাসা’ বাদে পারাপার-এর আর সব গল্পেই চরিত্রগুলো প্রতিবাদ করে। ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ কিন্তু প্রতিবাদী না, আত্মসমর্পণের গল্প। আত্মসমর্পণ এই অর্থে যে এখানে জোর করে কিছু করা হয়নি। যখন বয়স কম ছিল, প্রতিবাদ বিষয়টা কাজ করেছিল। ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’তেও মার্কসবাদের প্রভাব আছে, কিন্তু সেই উচ্চকিত বিষয়টি নেই। বাস্তব পরিণতি মেনে নেওয়া হয়েছে।


রনি: আপনার ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ গল্পটিকে কি জাদুবাস্তব গল্প বলা যায়?
জহির: বলতে পারেন। আমি তো এ রকম বিষয় ব্যবহার করি আগে থেকেই। জাদুবাস্তবতা নিয়ে কথা বলাটা খুবই স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে আমার বেলায়। আমি কথা অনেক সময়ই ভুলভাবে উদ্ধৃত করি। তাতে সমস্যা দেখা দেয়।


রনি: আপনার ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ গল্পে কাকগুলো কি কল্পপুরাণ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে?
জহির: লেখার সময় অত চিন্তা করি নাই। আসলে পাঠক আর লেখক−দুজনেই এক সমান। লেখার সময় লেখক স্বাধীনভাবেই লেখেন। এখন মেধাবী পাঠক নিজেও সৃজনশীলভাবে তার একটি সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি করে। তার অনেক কিছু মনে হয়। তার ভেতর থেকে অনেক দিকনির্দেশনা আসে। লেখক অনেক সময় ওসব চিন্তাই করেন না।


রনি: ‘সেই সময়’ গল্পটিকে কি আমরা প্রেমের গল্প বলব?
জহির: এটা প্রেমের গল্পই−যদিও সেখানে সময় আছে একটা। গল্পটির নাম প্রথমে ছিল ‘১৯৯২’, অর্থাৎ পত্রিকায় যখন সেটা ছাপা হয়েছে। তখন মারামারি, ধরাধরি, অস্িথরতা ইত্যাদি ছিল। আসলে বাংলাদেশের সব সময়ই এক। ১৯৯২ সালে যা, ২০০৮ সালেও তা-ই। নামটা তাই পাল্টে দিলাম।


রনি: আপনার সব গল্পই প্রায় মহল্লাভিত্তিক? ভুতের গলি নিয়ে অনেক গল্প আছে আপনার।
জহির: আমার জন্ন ভুতের গলিতে। ফলে জায়গাটা আমার পরিচিত। গল্প লিখতে হলে তো একটা আবহ তৈরি করতে হয়, একটা ভৌগোলিক পশ্চাদ্ভুমি লাগে। ভুতের গলি আমি ভালো চিনি। আরও মহল্লা ভালো চিনি। তো, ভুতের গলি আকর্ষণীয় মনে হয়।


রনি: ‘কাঁটা’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের, একে কি জাদুবাস্তবের গল্প বলা যায়?
জহির: এটা অতিবাস্তব। আমরা যে খুব সহজভাবে তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, ‘কাঁটা’ সে রকম গল্প না। এখানে সব ধর্মের লোকের প্রতি মহল্লার লোকদের সহানুভুতির উল্লেখ আছে; এসব বিষয়ে তাদের অপরাধবোধ ও অসহায়ত্বের কথা আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু−সবারই সমস্যা সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের অনেক নমস্য অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির গভীরে ঢুকলে আপনি দেখবেন, সাম্প্রদায়িকতা খুব গভীর একটা সমস্যা। আমার মনে হয়েছিল, এটা কীভাবে মনোজগতে থাকে, সেটা একটু দেখানো দরকার। এখানে কাঁটা শব্দটার ব্যবহার সেই অর্থে। এ গল্পের নাম আমি দুইবার বদলেছি। প্রথমে লিখেছি ‘কাঁটা’, পরে আবার লিখেছি ‘মনোজগতের কাঁটা’। কিছু লোকের আপত্তিতে পরে আবার পাল্টেছিলাম। তাদের মনে হয়েছে, বলে দেওয়ার দরকার নেই যে এটা মনোজগতের কাঁটা। কাঁটা বিভিন্ন রকমের আছে। পাঠক ঠিক করে নিক। পরে বইয়ের নাম দিয়েছিলাম জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এটা মূলত সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটি লেখা, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধেরও। এখানে যুদ্ধপূর্ব, যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর−তিন সময়ের কথাই আছে।


রনি: নকশাল আন্দোলন নিয়ে একটা গল্প আছে−‘ধুলোর দিনে ফেরা’। এটা তো অতিবাস্তব, নাকি বাস্তবই?
জহির: বাংলাদেশে তো তা-ই হয়েছে একসময়। নকশাল আন্দোলনে যারা গেছে, তাদের জীবনের পরিণতি তো করুণ। তাদের জন্য আমার যে অনুভুতি ও বেদনা, অনেকেরই সেটা আছে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। আগেই বলেছি, আমার লেখা মার্কসবাদে আচ্ছন্ন ছিল। এখনো সেটা আছে। প্রতিবাদী ভঙ্গি থেকে আমি সরে এসেছি, ওখান থেকে সরে আসা খুব মুশকিল। একবার যদি ওই দর্শন আপনার ভেতরে ঢোকে, আপনার তৈরি গল্পের রসায়নে ওই কেন্দ্র থেকে যায়। মার্কসবাদ মানে তো আসলে শুধু প্রতিবাদ না। এই গল্পে সত্তরের দশকের অবস্থাটা বলা হয়েছে। ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ গল্পে আবদুল ওহিদের ব্যর্থতার কারণ ওই আন্দোলনের ক্ষেত্রে অমানবিক একটি প্রসঙ্গ লালন করা।


রনি: এ গল্পে কিন্তু প্রেমও আছে।
জহির: প্রেম তো আছেই। কিন্তু আবদুল ওহিদ তো আর প্রেমের কারণে মরে নাই। সে পালিয়ে আসতে পারত। সে প্রেমের কারণে ফিরে আসে নাই। সে ফিরে এসেছে; যে কারণে সে গিয়েছিল, সেটা আর নাই। আশির দশকেই এটা বৈষয়িকভাবে শেষ হয়ে গেছে। এখন এটা বাংলাদেশের এক কোনায় চলে গেছে। এর অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু ওটা গুটিয়ে গেছে।


রনি: আপনার অন্য গল্পগুলো থেকে ‘চতুর্থ মাত্রা’ নানা কারণেই আলাদা। এতে আপনি ক্রিয়াপদের ভবিষ্যৎ রূপ ব্যবহার করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্ককার’-এও ক্রিয়াপদের একই ব্যবহার ছিল?
জহির: আমি ‘তেলেনাপোতা আবিষ্ককার’ পড়ি নাই। প্রেমেন্দ্র মিত্র কীভাবে কোন কাঠামোতে এটা ব্যবহার করেছেন, আমি জানি না। সৈয়দ শামসুল হকের মার্জিনে মন্তব্য-এ এই গল্পে ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। তাই জানতাম, তাঁর একটা গল্প আছে। কিন্তু এ নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তাও ছিল না যে লোকে বলবে, আমার ক্রিয়াপদের ব্যবহার প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছ থেকে এসেছে।


রনি: গল্পটিতে একটা দার্শনিকতা লক্ষ করা যায়।
জহির: আমি চাইছিলাম একেবারে গল্পহীনভাবে লিখতে। মানে, প্রায় কিচ্ছু না দিতে। গল্পের মধ্যে হাত দিলে কিছুই হাতে ঠেকবে না, এমন একটি গল্প লেখার ইচ্ছে ছিল। সেখান থেকে ‘চতুর্থ মাত্রা’ হয়েছে। গল্পে নায়ক কিছু করে না। তার কাজই মোটে দু-চারটা।


রনি: তার অর্থসংস্থান কীভাবে হয়? পুরোনো পত্রিকা বিক্রি করে কি চলে একটা মানুষের?
জহির: এর কোনো উত্তর নাই। হয়তো মাঝখানে সে চাকরি করে, এদিক-ওদিক যায়। হতে পারে। কিন্তু বাসায় যখন থাকে, তখন সে এগুলো করে।


রনি: এই গল্পে এই যে একটার পর একটা গ্লাস ভাঙা হয়, এটা কি প্রতীকী কোনো কিছু?
জহির: না, লোকটি যোগাযোগের চেষ্টা করে। কথাবার্তা বলা, সম্পর্ক তৈরি করা−এসব সামাজিক দক্ষতা তার কম। সে গৃহকেন্দ্রিক ও অলস। কিন্তু বাইরের জগতের সঙ্গে সে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে। আমি একজন পাঠকের ব্যাখ্যা আপনাকে বলছি। এ ব্যাখ্যাটা আমার ভালো মনে হয়েছে। গ্লাস ভেঙে ভেঙে সে বাইরের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে। কাগজ বিক্রি করে, যাতে কাগজওয়ালার সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকে। সে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এটা হতে পারে, আমি নিশ্চিত না।


রনি: এই যে লোকটার গ্লাস ভাঙা নিয়ে আপত্তি আসছে, তখন সে দুইটা ভাঙছে, তারপর তিনটা, তারপর চারটা−এর মধ্যে কি কোনো দার্শনিক বক্তব্য আছে?
জহির: মানুষের জীবনটাই তো দার্শনিকতাপূর্ণ। এটা মানুষের অতিকর্মতৎপরতার বিপক্ষে লেখা। মানুষের এত এত কর্মতৎপর হওয়ার দরকার কী? এত কাজ করে আমরা কী করব?


রনি: এটা কি হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হলো না?
জহির: হতে পারে। জীবনে কর্মতৎপর হওয়া এবং কিছু জিনিস অর্জন করাটাকে আমরা আশাবাদ বলি। কেউ হয়তো বলতে পারে, অর্জনের জন্য যে দৌড়, তাতে তো মানুষ এগোবে না। ব্যাপারটা এত সরল না। আপনি কি এভাবে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারবেন? এই দৌড়ের মধ্যে ব্যক্তিমানুষ খুব আরামে নাই।


রনি: আপনার প্রথম উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার বয়ান ও পটভুমি একেবারে আলাদা। এটি এক অনুচ্ছেদে লেখা একটি উপন্যাস?
জহির: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পড়ে আমার মনে হয়েছিল, কোথাও আমি এ রকম পড়িনি। এর মধ্যে চিত্রকর্মের একটা গড়ন আছে। পিকাসোর গুয়েরনিকার যে রকম একটা কিউবিক ফর্ম, একটা জিনিস ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া আছে। ঘোড়ার মাথা একদিকে, পা অন্যদিকে। কিউবিক শৈলীতে এককভাবে আপনি বিষয়টি আঁকছেন না। আমার মনে হয়েছে, একটি গল্পও যেভাবে খুশি বলা যায়। সেখানে দেখবেন, একটি কথা বলতে বলতে পরের লাইনে আরেকটি কথা চলে আসছে। গল্পের ছক এভাবে ভেঙে ফেলার কারণে আমি যাতায়াত করতে পেরেছি খুব দ্রুত।


রনি: এ উপন্যাসের কলেবর ছোট, কিন্তু অভিঘাত অনেক বিস্তৃত।
জহির: এটা ভেঙে লিখলে হয়তো আরও বড় হতো। বড় করতে চাই নাই কয়েকটা কারণে। প্রথমত, এর প্রয়োজন ছিল না। এটার প্রকাশ নিয়েও সমস্যা ছিল। যত বড় হতো, প্রকাশ করতেও তত কষ্ট হতো। আর গল্পের চাহিদার চেয়ে জোর করে বড় করার তো দরকার নেই। এর কাহিনীতে অনেক সময় পার হয়েছে। ১৯৮৫ সালে শুরু হয়েছে, একাত্তরে ফিরে গেছে, আবার ১৯৮৫-র পরে এসে গল্প শেষ হয়েছে। তিনটা কালস্তরে চলাচলের একটা ব্যাপার ছিল। গল্পের ভেতরে তো লেখককেও চলাচল করতে হয়। আমাদের সাহিত্যের পরিচিত কাঠামোয় এভাবে চলাচল করা কঠিন। একটা থেকে আরেকটা সময়ে গেলে, লেখক হিসেবে আমি দেখি, বর্ণনায় সমস্যা তৈরি হয়। তখন জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে এ কাজটা আমি করি। অনেকে এও বলেছে, এটা নাকি মার্কেজের লেখার অনুবাদ।


রনি: আপনার গল্পের চরিত্রগুলো উপন্যাসেও ফিরে ফিরে আসে। কেন?
জহির: নামগুলো প্রায় এক। এটা ইচ্ছাকৃত। হাজার হাজার নাম দেওয়ার দরকারটাই বা কী।


(সাক্ষাৎকারটি শহীদুল জহিরের ইস্কাটনের বাসায় প্রায় চার ঘণ্টা ধরে নেওয়া। ছাপার আগে তাঁকে দেখিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। সে কথা আর রাখা হলো না।−আর কে রনি)

.

.

একজন নিরিবিলি মানুষ

শহীদুল জহিরের সঙ্গে আকষ্মিকভাবে পরিচয় হয়েছিল। তারপর তাঁরা ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, ঘনিষ্ঠ থেকেছেন। সেসব দিনের কথা লিখেছেন মোহাম্মদ সাদিক
___
আশির দশকের শেষ থেকে গ্রিন রোডে অফিসার্স হোস্টেলে সিভিল সার্ভিসের ৭০-৮০ জন কর্মকর্তা থাকতেন। তিনটি ভবনের মধ্যে দুই নম্বর ভবনের নিচতলায় প্রথম বাঁ পাশের ইউনিটে বাস করতেন একজন নিরিবিলি মানুষ। বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সৌহার্দ্য ও হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বেশির ভাগ কর্মকর্তা অবিবাহিত হিসেবে হোস্টেলে উঠলেও পরে তাঁদের অনেকেই সস্ত্রীক এই হোস্টেলে বাস করতে শুরু করেন। কিন্তু দুই নম্বর ভবনের নিচতলার বাঁ পাশে দুই নম্বর ইউনিটের ভদ্রলোক অন্যদের চেয়ে জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও একাই আছেন। কডের প্যান্ট, ব্লেজার এবং কিছুটা ভারী জুতো পরে গম্ভীর ভঙ্গিতে সিনা টান টান করে আশপাশে না তাকিয়ে দীর্ঘ পদক্ষেপে তিনি যখন হেঁটে যেতেন, তখন তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করার সাহসও সবার হতো না। আমি নিজেও সসংকোচে তাঁর পথ ছেড়ে দিতাম। তার কারণ, তিনি সার্ভিসে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র, তাঁর গাম্ভীর্য এবং ব্যক্তিত্ব আমার কাছে প্রাচীরের মতো মনে হতো।একদিন তাঁর পাশের ইউনিটের কর্মকর্তার সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে তাঁর ইউনিটের সামনে দিয়ে ফিরছি, খোলা দরজা দিয়ে দেখি একটি খাটের ওপর সাদা খদ্দরের চাদর গায়ে শুয়ে আছেন তিনি। ঘরময় ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে অনেক বই। কিছুটা কৌতুহল হয়, আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। দরজার পাশেই দেখতে পাই ধুলোর আস্তরণে ঢাকা কিছু বই। গ্যেটের ফাউস্ট, হোমারের ইলিয়াড, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা, আরও অনেক দেশি-বিদেশি দামি বই। আমি তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি দেখে তিনি উঠে বসলেন। আমি সব শঙ্কা, ভয় উপেক্ষা করে তাঁকে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকি। তিনি কিছুটা ব্যস্ত হয়ে আমাকে কোথায় বসতে দেবেন ভেবে চারদিক তাকালেন, তারপর একটি বেতের চেয়ার দেখিয়ে আঙ্গুলের ইশারায় বসতে বললেন। আমি দেখলাম, ঘরজুড়ে আরও অনেক বই। একটি শোকেস, একটি ছোট টেবিল, চেয়ার; পাতলা একটি বিছানা, তোশক আছে বলে মনে হয় না। আমি কথা শুরু করতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন আছেন?' আমি আমতা আমতা করে কী বলেছিলাম মনে নেই। পরে অনেক কষ্টে তাঁকে শুধু বললাম, আপনার ফ্লোরে তো অনেক দামি বই ছড়িয়েছিটিয়ে আছে, এখান থেকে কিছু বই ফেরত দেওয়ার শর্তে পড়ার জন্য নিতে চাই।তিনি হাসলেন। এই প্রথম তাঁকে আমি হাসতে দেখি। তিনি সরাসরি বললেন, 'বই নেবেন? নিয়ে যান।' আমি সত্যি সত্যি বাচ্চা ছেলের মতো বই কুড়াতে শুরু করি। কোনার দিকে একই ধরনের কিছু গাদা করা বই। জিজ্ঞেস করি, একই বইয়ের এত কপি কেন? তিনি বললেন, 'আমি লিখেছিলাম, হাਆানী থেকে বেরিয়েছিল। বিক্রি হয় না দেখে রেখে দিয়েছি। ওটা আপনার নিয়ে কাজ নেই।' আমি অন্য ক্লাসিকসের সঙ্গে এর একটি কপি নিই। আমার মনে হলো, যাঁর কাছ থেকে এতগুলো বই নিচ্ছি তাঁর নিজের লেখা একটি বই না নেওয়াটা শোভন হয় না।সময়ক্ষেপণ না করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিই। কিন্তু তাঁর ঘর, তাঁর জীবনযাপন এবং তাঁর বই নির্বাচনের ধরন দেখে আমার বিস্নয় আমি ভুলতে পারি না। তৃতীয় তলার নিজের ঘরে ফিরে বইয়ের ধুলোবালি মুছে প্রথমে তাঁর লেখা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকি। পরে দেখা হলে তাঁর বইটি সম্পর্কে জানতে চাইতে পারেন। (সে বই শুধু নয়, তাঁর কোনো বই সম্পর্কেই কোনো দিন আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাননি)। লেটার প্রেসে ছাপা খুব সাদামাটা একটা বই। উপন্যাস। সাদাকালো প্রচ্ছদ এবং তাতে একটি আপেলের ছবি, বইয়ের নাম এবং লেখকের নাম। প্রচ্ছদ করেছেন লেখক নিজে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়তে শুরু করি।প্রথম পৃষ্ঠা পড়ার পর আমি আর থামতে পারি না। এক বসাতেই ৬৪ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে শেষ করি। তারপর নিচতলায় দুই নম্বর ইউনিটে ছুটে যাই। দেখি দরজায় তালা ঝুলছে। দুপুর থেকে রাত অবধি আমি বেশ কয়েকবার ওখানে যাই, তিনি ফেরেন না। অবশেষে বারান্দায় চেয়ার পেতে পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। রাত ১১টার দিকে অফিসার্স হোস্টেলের গেট দিয়ে ছায়ার মতো একটি দীর্ঘ শরীর, দীর্ঘ পদক্ষেপে হেঁটে আসতে থাকে। বুঝতে পারি, তিনি আসছেন। আমি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি। একটু অবাক হন তিনি। আমি আবেগ ধরে রাখতে পারি না; বলি, দুপুরে সাদাকালো মলাটের যে বইটি আমি নিয়েছিলাম, সেটি আমি পড়ে ফেলেছি এবং এটি আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, 'তাই নাকি?' তাঁর এই হূদয়খোলা হাসি দেখে বুঝতে পারি, তিনি আমার স্বজন। আমি চার-পাঁচটি বই নিয়ে সমকালের সেরা কিছু লেখককে পৌঁছে দিই। বিচিত্রায় এক পৃষ্ঠার একটি রিভিউ লিখি। এই লেখকের নাম শহীদুল জহির এবং উপন্যাসটির নাম জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। তাঁর নাম লেখকদের মধ্যে পৌঁছে যেতে থাকে। এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে। তার একটি কপি আমাকে দিতে গিয়ে তিনি লেখেন−'এই বইয়ের দ্বিতীয় মা, কবি মোহাম্মদ সাদিককে।'যে মানুষটির চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল ছিল বলে বহুদিন ভয়ে-সংকোচে তাঁর কাছে যাইনি, তিনি আমার প্রিয় মানুষে পরিণত হলেন। সাদামাটা, সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতেন। পরিমিতিবোধ ছিল তাঁর প্রধান প্রবণতা। শীত, গ্রীষ্ক্ন, বর্ষা−সব সময়ই তাঁকে একটি খদ্দরের চাদর গায়ে শুতে দেখেছি। খুবই সাধারণ শক্ত বিছানা ছিল তাঁর। বই নির্বাচনে ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল। আবহমান বাংলার বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর কৌতুহল ছিল। চিরঞ্জীব বনৌষধি তাঁর সংগ্রহে দেখে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আয়ুর্বেদে আপনার আগ্রহ আছে? তিনি বললেন, না, তা নেই, কিন্তু এই বইয়ের বিভিন্ন বিবরণ থেকে তিনি তাঁর লেখার রসদ সংগ্রহ করেন। তাঁর নোটবুকে বিভিন্ন রেকর্ডস থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য পাই, যেমন:সিরাজগঞ্জে জিনিসপত্রের দামচালের মণ-১৮৭০−১.৫০ টাকাচাল টাকায়১৯১৩−৮.৫০ সের১৯১৮−১০.৩/৪ সের১৯৩০−৬ সের মজুরি কৃষি শ্রমিক−দৈনিক ১৮৪০−০.০৯ টাকা১৮৭৫−০.১৪ টাকাবাধাশ্রমিক বার্ষিক (২০-এর দশক) ৬০-৮৪ টাকা + খাবার + কাপড়এ রকম নানা তথ্য-উপাত্ত তিনি সংগ্রহে রাখতেন এবং লেখার মধ্যে ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনায় দিনক্ষণ, তারিখ কিংবা বার ব্যবহারে বাস্তবতার সমান্তরালে থাকতেন।দারপরিগ্রহ না করার বিষয়টি বেশ আলোচনার বিষয় ছিল। কারও এ বিষয়ে প্রশ্ন করার সাহস ছিল না। আমার ও আমার পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে কেউ কেউ আমাদের কাছে তাঁদের কৌতুহলের কথা বলতেন। অন্যদের কৌতুহলের কথা দু-একবার তাঁকে বলেছি। তিনি হাসতেন এবং অন্যদের উৎকন্ঠার কথা বিবেচনা করে কিঞ্চিৎ হতাশ হতেন। একদিন এও বলেছিলেন, অনেক ভেবেচিন্তে এ বিষয়টি বাদ দিয়েছি। এ চ্যাপ্টার ক্লোজড।পড়াশোনা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ইংরেজিতে তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। দাপ্তরিক কাজে তাঁকে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়েছে। দেশের স্বার্থে বিভিন্ন ডকুমেন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে তিনি কখনো শৈথিল্য দেখাননি। আমার এক সহকর্মী মাসুদ সিদ্দিকী আমাকে বলেছিল, বিদেশে একটি নেগোসিয়েশন টিমের সঙ্গে কথা বলার প্রস্তুতি হিসেবে তিনি ওই সফরে হোটেলে রাত চারটা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিশাল ডকুমেন্টের প্রতিটি শব্দ ভালোভাবে যাচাই করে নিয়েছেন। আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তাঁর দক্ষতা ও সততা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁকে, তাঁর বিবেককে কিনতে পারে এ রকম চেকবই নিয়ে পৃথিবীতে কেউ ছিল না।দীর্ঘদিন গ্রিন রোডে প্রথমে দুই নম্বর ইউনিটের নিচতলায় ও পরে তৃতীয় তলার ১০ নম্বর ইউনিটে বাস করেন তিনি। তারপর বেইলী রোডে, অতঃপর ইস্কাটনে অরুণিমা-২। তাঁর খাওয়া-দাওয়া ছিল অদ্ভুত এক ছকে বাঁধা। তিনি টেবিলের ওপর টাকা রেখে যেতেন। কাজের বুয়া এসে তাঁর ইচ্ছামতো বাজার করে রান্নাবান্না করে হাঁড়ি-পাতিলসহ টেবিলে রেখে যেতেন। বুয়ার সঙ্গে কালেভদ্রে তাঁর দেখা বা কথা হতো। রান্নাবান্না সম্পর্কে কোনো মন্তব্য পাওয়া যেত না, যেমন রান্নাই হোক। কখনো চার্লি চ্যাপলিনের কথা বলতেন। একটি ছবিতে চার্লি চ্যাপলিন ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যেও একটি ডিম সেদ্ধ খাওয়ার জন্য ন্যাপকিনসহ প্লেট সাজিয়ে বসেছিলেন, এই রুচির প্রশংসা করতেন তিনি। তাঁর ভাষায়, 'চ্যাপলিন হলেন বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ভদ্রলোক চরিত্র।' খুব সাধারণ কাপড়চোপড় পরতেন তিনি। দাপ্তরিক প্রয়োজন ছাড়া পারতপক্ষে টাই পরতেন না। কথা-আচার-আচরণে খুবই সংযত ছিলেন। কখনো কখনো তাঁকে আমার আধুনিক দরবেশ বলে মনে হয়েছে।লেখার জন্য আলাওল পুরস্কার পাওয়ার পর খুশি হয়েছিলেন। খুশির হওয়ার কারণ পুরস্কারটির নিরপেক্ষতা। রাত করে ফিরতেন। পুরস্কার পাওয়ার পর রাত ১২টায় আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে যাই। আমার মেয়ে সুরমা তাকে ফুল দেয়। পরে আজকের কাগজ পুরস্কার পেয়েছেন। সে জন্য তাঁকে আনন্দিত মনে হয়েছে। লেখালেখির বিষয়ে আড্ডা হতো তাঁর অথবা আমার ঘরেই। দু-একবার অন্য জায়গায় আড্ডা হয়েছে। লেখক হিসেবে অন্যদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হককেও তিনি গুরুত্ব দিতেন। একবার আমরা দুজন তাঁর একটি বই নিয়ে হক ভাইয়ের ওখানে গিয়েছিলাম। এমনিতে তাঁর ব্যাচমেট কিছু বন্ধু ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে হয়তো ইতিপূর্বে তাঁর আড্ডা হতো। তবে আমাদের ব্যাচের আলী মোস্তফা চৌধুরী ও পুলিশের ফণীদাকে পছন্দ করতেন। লেখকদের সঙ্গে আড্ডায় যাওয়ার কথা বললে প্রায়শ আমাকে বলতেন, 'আড্ডায় গিয়ে কী হবে? একটি ভালো মন নিয়ে আড্ডায় গিয়ে ফিরে এসে দেখি, শরীরের এখানে-ওখানে রক্ত লেগে আছে। বাঘনখে অনেকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে আমাকে। এ জন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না।'শিশুদের তিনি খুব পছন্দ করতেন। আমার বাচ্চারা ছিল তাঁর দারুণ ভক্ত। বাচ্চারা তাঁকে কেন এত পছন্দ করে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, 'কথা বলার সময় তাদের বাচ্চা মনে করবেন না, ব্যক্তি মনে করবেন। দেখবেন, তারা খুব খুশি হবে এবং ব্যক্তির মতোই আচরণ করবে। কিন্তু আমরা অনেকেই তা করি না।'পারতপক্ষে কখনো কাউকে বলতেন না যে, তিনি লেখেন। খুব কম লিখতেন। উলুখাগড়ার জন্য একটি গল্প চাইলে বলেছিলেন, 'এরপর যে গল্পটি লিখব, সেটি উলুখাগড়ায় দেব।' আমি আকরম স্যারকে (অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন) কথা দিয়েছিলাম লেখা আদায় করে দেব। শহীদ ভাই কথা দিলে কথা রাখতেন। সেই অলিখিত গল্পের কাহিনী ও নির্মাণশৈলী কী হতো, জানি না। তার আগেই শহীদ ভাই একটি অবিস্নরণীয় ছোটগল্পের মতো পৃথিবীকে পেছনে রেখে চলে গেলেন। মিরপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করার সময় আমার ছেলে সৃজন শোকার্ত হতে থাকে। আমার মেয়ে সুরমা জায়নামাজে বসে তাঁর শহীদ কাকুর জন্য প্রার্থনা করে। তার চোখে জল। তারা সচিব মো. শহীদুল হককে চেনে না। দেশবরেণ্য কথাশিল্পী তাদের কাছে বিবেচনার বিষয় নয়। তারা চেনে প্রিয় শহীদ কাকুকে। মানুষ শহীদুল জহির কেমন ছিলেন, তাদের চেয়ে আর কে ভালো জানে! ক্রিকেট খুব পছন্দ করতেন। উল্লেখযোগ্য ওয়ানডেগুলো আমরা একসঙ্গে দেখতাম। বিশ্বকাপ, পাকিস্তান-বাংলাদেশ ওয়ানডে−আমরা সোবহানবাগে, শহীদ ভাই গ্রিন রোডে। ওই দিন শহীদ ভাই আসেননি। পাকিস্তানের একটার পর একটা উইকেট পড়ছে। উত্তেজনায় কাঁপছে বাংলাদেশ। আমি, আমার বাচ্চারা শহীদ ভাইকে মিস করছি। আর মাত্র দুটি উইকেট বাকি। হঠাৎ দরজায় কলবেলের শব্দ। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখি শহীদ ভাই, বললেন, 'আর থাকা গেল না, চলে এলাম।' বাসার সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠি। যেন আর একটি উইকেট পড়েছে। সেদিন ঢাকার রাস্তায় আমার বাচ্চাদের সঙ্গে শহীদ ভাই বিজয় মিছিলে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। হইচই করলেন, নাচলেন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার অনেক রাস্তা ঘুরে আমরা ঘরে ফিরি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগামী যেকোনো বিজয়ের পূর্বমুহুর্তে শহীদ ভাই কি পুনরায় কলবেল বাজাবেন, বলবেন কি, 'আর পারা গেল না, চলে এলাম!

Thursday, March 27, 2008

কোথায় পাব তারে


আনিসুল হক
-

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অনেক দিন শহীদুল জহিরকে খুঁজেছেন। শহীদুল জহিরের গল্প কোথায় পাব তারে থেকে তিনি টিভিনাটক বানাবেন। ‘কী সরয়ার, পাইছ শহীদুল জহিরকে?’ ‘না, পাই নাই। আর খুঁজতেছি না। গল্পটা পাল্টায়া দিছি। শহীদুল জহিরকে সবাই খুঁজতেছে, এইটাই এখন গল্প। কাজেই আর তাঁর পারমিশন লাগবে না।’সরয়ার নাটকটি বানিয়েছিলেন। ২১ মার্চ ২০০৮ রাতে সরয়ারকে ফোন দিই। সরয়ার, শুনছ, শহীদুল জহির হাসপাতালে। আজ শুক্রবার বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি প্রথমে হলিফ্যামিলিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। গেটে পড়ে গেলে দ্বাররক্ষীরা তাঁকে হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয়েছে ল্যাবএইডে।সরয়ারও উদ্বিগ্ন। কারণ, আমরা দুজনেই জানি, ভদ্রলোক বিয়ে-শাদি করেননি। একাকী একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। হাসপাতালে কেউ তাঁর পাশে আছে তো!২২ মার্চ দুপুরে সরয়ার আর আমি যাই ল্যাবএইড হাসপাতালে। সিসিইউতে রাখা আছেন শহীদুল হক। হ্যাঁ, এটা তাঁর আসল নাম। তিনি সরকারের পার্বত্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব। তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে দেখতে আসছেন। একটু আগে কেবিনেট সেক্রেটারি এসেছিলেন। তাঁর ভাই আর বোনেরাও সেখানে উপস্িথত।কাজেই আমাদের দুজনের প্রাথমিক যে উদ্বেগ ছিল, তাঁর পাশে কেউ নাই, সেটা কেটে যায়।আমরা সিসিইউতে ঢুকে পড়লাম। আমার দুই বগলে ক্রাচ থাকায় একটা সহজ প্রবেশাধিকার পেয়ে যাই।সিসিইউতে কাউকে দেখার চেয়ে না দেখাই ভালো। যন্ত্রপাতি নাকে-মুখে নিয়ে একটা লোক অচেতন শুয়ে থাকে। তবু, তাঁর বইয়ের শিরোনামের মতোই, মুখের দিকে দেখি।শহীদুল জহিরের ভাই মুনিরুল হকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, কালকে ডাক্তাররা বলেছেন, বাঁচার আশা অপারেশন করলে ৮ শতাংশ, না করলে ১ শতাংশ। এখন এনজিওগ্রাম করে দেখা গেছে, হার্ট ভালো আছে।শুনে খানিকটা বল পাই। আমরা দুজন যে বার্তাটা দিতে গেছি, সেটা তাঁকে জানিয়ে দিই, কোনো রকমের দরকার হলে আমাদের জানাবেন। আমরা অবশ্যই আপনাদের দুঃখ, আনন্দ আর দায় ভাগ করে নেব।২৩ মার্চ সকালে কবি মোহাম্মদ সাদিক (পরিচালক, বিয়াম) ফোন করলেন। সব শেষ।আবার হাসপাতালে যাই। সামনে পতাকাদন্ডসমেত অনেক গাড়ি। সচিব, উপসচিব, সহকর্মীরা এসে ভিড় করেছেন।শহীদুল জহিরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।সাকল্যে দুজন লেখককে দেখতে পাই। কবি সমুদ্র গুপ্ত (শহীদুল জহিরের চাচাতো ভাই) আর কবি কামাল চৌধুরী (ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা)।লেখকেরা বোধ হয় এখনো খবর পাননি।অথবা শহীদুল জহির তো খুবই নিভৃতচারী লেখক ছিলেন, কোনো গোষ্ঠী, গোত্র, দল করতেন না, কথা বলতেন কম, বেরোতেন আরও কম, তার সরকারি বাসায় সারা মেঝেতে বই ছড়িয়ে একা থাকতেন, সে কারণেও হয়তো লেখকদের ভিড়টা হয়নি।কিন্তু শহীদুল জহির যে বাংলা কথাসাহিত্যের একজন প্রধান পুরুষ, এটা অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন।আমার এক বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে একই ঘরে দুই রাত থাকার। তিনি সেবার ফরিদপুরে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন। আর আমি অনুষ্ঠানে গেছি আমন্ত্রিত হয়ে। দুজনকে একটা সরকারি রেস্ট হাউসে একই ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমি তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বললাম। প্রধানত আমিই বললাম। আর তাঁর সম্পর্কে আমার যেসব জিজ্ঞাস্য ছিল, সেসব জানার চেষ্টা করলাম। তখনই এই তথ্য জানা হয়ে গেল যে তিনি কোনো গোষ্ঠীর নন, কোনো লিটল ম্যাগাজিন ঘরানার নন, কারও কাছে যান না, একাকী নিভৃতে কাজ করে চলেছেন।বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর নাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে একই বাক্যে উচ্চারণ করতে হবে।মৃত্যুর পরে সবার সম্পর্কে ভালো ভালো কথাই বলতে হয়। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রথম আলোর ২০০৪ সালের সাহিত্য সাময়িকীর সেরা ১০ বইয়ের আলোচনায় লিখেছিলাম: ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প পড়তে গিয়ে ভেতরে ভেতরে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই−শহীদুল জহির এখন বাংলাদেশের ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান পুরুষে পরিণত হয়েছেন। শুধু অস্িথর বর্তমান নয়, অনাগত ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ইতিহাসে তাঁকে একটা আসন দিতে হবে।’শহীদুল জহির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাষা শুধু ব্যবহার নয়, ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার আমার আছে। তোরে একটা ভাষা দিলাম ব্যবহার কর, কিন্তু খবরদার নষ্ট করবি না−ব্যাপারটা এ রকম হইতে পারে না, কেউ এ রকম ভাবে হয়তো, ফলে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করে।... আমি শুধু কথাসাহিত্যের সংলাপ না, টেক্সটের ক্ষেত্রে নতুন বাক্য বিন্যাস এবং ভাষা প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। ...মান চলতি ভাষাকে ভেঙে ঢাকার মানুষেরা একটা শোভন ব্যবহারিক কথ্য ভাষা তৈরি করেছে, এখনো করছে। আমাদের প্রয়োজনেই আমরা এই ভাষাটাকে তৈরি করেছি।’ (শহীদুল জহিরের সঙ্গে কথোপকথন, কথা, কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।) এই কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন, যেমন: ‘আবদর রহমান এই অবস্থায় পড়ে চাপা খায়া থাকে। ...তার কপালে দুপাশে মলম লাগায়া টিপা দিলে সে তার...সব বুঝায়া বলে...’পারাপার, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প, মুখের দিকে দেখি−তাঁর বইয়ের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। তাঁর সংলাপ রচনার শক্তির তুলনা কেবল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সুর্য দীঘল বাড়ির আবু ইসহাকের সঙ্গে করা যেতে পারে। আর রসবোধ-কৌতুকবোধের এই রকম পরিশীলিত কিন্তু অত্যুজ্জ্বল ব্যবহার পাঠককে বিমোহিত করে তুলত।তাঁর গল্প থেকে ছবি হয়েছে−ফুলকুমার, নুরুল আলম আতিক নাটক বানিয়েছেন চতুর্থ মাত্রা। বুদ্ধদেব বসু সুত্রে জানি, বোদলেয়ারের নামের বানান সমকালীন লেখকেরা নির্ভুল লিখতে পারতেন না, তাঁর শবযাত্রায় লোক হয়েছিল খুব কম। শহীদুল হকের শেষকৃত্যে লোকের অভাব হবে না। কারণ, তিনি সরকারের সচিব ছিলেন, কিন্তু সমকালীন সাহিত্যিকেরা কজন উপস্িথত থাকতে পারবেন, আমি জানি না।কিন্তু এ কথা মেনে নিতে একদিন কারোরই অসুবিধা হবে না যে বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে শহীদুল জহিরের আসন চিরস্থায়ী।আমরা, তাঁর সাহিত্যের অনুরাগী ও মুগ্ধ পাঠকেরা, মাত্র ৫১ বছর বয়সে তাঁর এই হঠাৎ প্রস্থানকে মেনে নিতে পারছি না, তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর মতোই আমাদের ঘোরগ্রস্ত লাগছে, আমরা আকুল হয়ে তাঁর স্িথর হয়ে যাওয়া মুখের দিকে দেখি, কেবল শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই, তাঁকে আমরা খুঁজতে থাকি, তাঁর খোঁজে ঢুঁড়তে থাকি পাড়ামহল্লা−কিন্তু কোথায় পাব তাঁরে!

আনিসুল হক: লেখক ও সাংবাদিক।
ই-মেইল: anisulhoquem@yahoo.com