Thursday, March 27, 2008

কোথায় পাব তারে


আনিসুল হক
-

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অনেক দিন শহীদুল জহিরকে খুঁজেছেন। শহীদুল জহিরের গল্প কোথায় পাব তারে থেকে তিনি টিভিনাটক বানাবেন। ‘কী সরয়ার, পাইছ শহীদুল জহিরকে?’ ‘না, পাই নাই। আর খুঁজতেছি না। গল্পটা পাল্টায়া দিছি। শহীদুল জহিরকে সবাই খুঁজতেছে, এইটাই এখন গল্প। কাজেই আর তাঁর পারমিশন লাগবে না।’সরয়ার নাটকটি বানিয়েছিলেন। ২১ মার্চ ২০০৮ রাতে সরয়ারকে ফোন দিই। সরয়ার, শুনছ, শহীদুল জহির হাসপাতালে। আজ শুক্রবার বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি প্রথমে হলিফ্যামিলিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। গেটে পড়ে গেলে দ্বাররক্ষীরা তাঁকে হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয়েছে ল্যাবএইডে।সরয়ারও উদ্বিগ্ন। কারণ, আমরা দুজনেই জানি, ভদ্রলোক বিয়ে-শাদি করেননি। একাকী একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। হাসপাতালে কেউ তাঁর পাশে আছে তো!২২ মার্চ দুপুরে সরয়ার আর আমি যাই ল্যাবএইড হাসপাতালে। সিসিইউতে রাখা আছেন শহীদুল হক। হ্যাঁ, এটা তাঁর আসল নাম। তিনি সরকারের পার্বত্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব। তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে দেখতে আসছেন। একটু আগে কেবিনেট সেক্রেটারি এসেছিলেন। তাঁর ভাই আর বোনেরাও সেখানে উপস্িথত।কাজেই আমাদের দুজনের প্রাথমিক যে উদ্বেগ ছিল, তাঁর পাশে কেউ নাই, সেটা কেটে যায়।আমরা সিসিইউতে ঢুকে পড়লাম। আমার দুই বগলে ক্রাচ থাকায় একটা সহজ প্রবেশাধিকার পেয়ে যাই।সিসিইউতে কাউকে দেখার চেয়ে না দেখাই ভালো। যন্ত্রপাতি নাকে-মুখে নিয়ে একটা লোক অচেতন শুয়ে থাকে। তবু, তাঁর বইয়ের শিরোনামের মতোই, মুখের দিকে দেখি।শহীদুল জহিরের ভাই মুনিরুল হকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, কালকে ডাক্তাররা বলেছেন, বাঁচার আশা অপারেশন করলে ৮ শতাংশ, না করলে ১ শতাংশ। এখন এনজিওগ্রাম করে দেখা গেছে, হার্ট ভালো আছে।শুনে খানিকটা বল পাই। আমরা দুজন যে বার্তাটা দিতে গেছি, সেটা তাঁকে জানিয়ে দিই, কোনো রকমের দরকার হলে আমাদের জানাবেন। আমরা অবশ্যই আপনাদের দুঃখ, আনন্দ আর দায় ভাগ করে নেব।২৩ মার্চ সকালে কবি মোহাম্মদ সাদিক (পরিচালক, বিয়াম) ফোন করলেন। সব শেষ।আবার হাসপাতালে যাই। সামনে পতাকাদন্ডসমেত অনেক গাড়ি। সচিব, উপসচিব, সহকর্মীরা এসে ভিড় করেছেন।শহীদুল জহিরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।সাকল্যে দুজন লেখককে দেখতে পাই। কবি সমুদ্র গুপ্ত (শহীদুল জহিরের চাচাতো ভাই) আর কবি কামাল চৌধুরী (ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা)।লেখকেরা বোধ হয় এখনো খবর পাননি।অথবা শহীদুল জহির তো খুবই নিভৃতচারী লেখক ছিলেন, কোনো গোষ্ঠী, গোত্র, দল করতেন না, কথা বলতেন কম, বেরোতেন আরও কম, তার সরকারি বাসায় সারা মেঝেতে বই ছড়িয়ে একা থাকতেন, সে কারণেও হয়তো লেখকদের ভিড়টা হয়নি।কিন্তু শহীদুল জহির যে বাংলা কথাসাহিত্যের একজন প্রধান পুরুষ, এটা অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন।আমার এক বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে একই ঘরে দুই রাত থাকার। তিনি সেবার ফরিদপুরে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন। আর আমি অনুষ্ঠানে গেছি আমন্ত্রিত হয়ে। দুজনকে একটা সরকারি রেস্ট হাউসে একই ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমি তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বললাম। প্রধানত আমিই বললাম। আর তাঁর সম্পর্কে আমার যেসব জিজ্ঞাস্য ছিল, সেসব জানার চেষ্টা করলাম। তখনই এই তথ্য জানা হয়ে গেল যে তিনি কোনো গোষ্ঠীর নন, কোনো লিটল ম্যাগাজিন ঘরানার নন, কারও কাছে যান না, একাকী নিভৃতে কাজ করে চলেছেন।বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর নাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে একই বাক্যে উচ্চারণ করতে হবে।মৃত্যুর পরে সবার সম্পর্কে ভালো ভালো কথাই বলতে হয়। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রথম আলোর ২০০৪ সালের সাহিত্য সাময়িকীর সেরা ১০ বইয়ের আলোচনায় লিখেছিলাম: ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প পড়তে গিয়ে ভেতরে ভেতরে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই−শহীদুল জহির এখন বাংলাদেশের ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান পুরুষে পরিণত হয়েছেন। শুধু অস্িথর বর্তমান নয়, অনাগত ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ইতিহাসে তাঁকে একটা আসন দিতে হবে।’শহীদুল জহির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাষা শুধু ব্যবহার নয়, ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার আমার আছে। তোরে একটা ভাষা দিলাম ব্যবহার কর, কিন্তু খবরদার নষ্ট করবি না−ব্যাপারটা এ রকম হইতে পারে না, কেউ এ রকম ভাবে হয়তো, ফলে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করে।... আমি শুধু কথাসাহিত্যের সংলাপ না, টেক্সটের ক্ষেত্রে নতুন বাক্য বিন্যাস এবং ভাষা প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। ...মান চলতি ভাষাকে ভেঙে ঢাকার মানুষেরা একটা শোভন ব্যবহারিক কথ্য ভাষা তৈরি করেছে, এখনো করছে। আমাদের প্রয়োজনেই আমরা এই ভাষাটাকে তৈরি করেছি।’ (শহীদুল জহিরের সঙ্গে কথোপকথন, কথা, কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।) এই কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন, যেমন: ‘আবদর রহমান এই অবস্থায় পড়ে চাপা খায়া থাকে। ...তার কপালে দুপাশে মলম লাগায়া টিপা দিলে সে তার...সব বুঝায়া বলে...’পারাপার, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প, মুখের দিকে দেখি−তাঁর বইয়ের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। তাঁর সংলাপ রচনার শক্তির তুলনা কেবল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সুর্য দীঘল বাড়ির আবু ইসহাকের সঙ্গে করা যেতে পারে। আর রসবোধ-কৌতুকবোধের এই রকম পরিশীলিত কিন্তু অত্যুজ্জ্বল ব্যবহার পাঠককে বিমোহিত করে তুলত।তাঁর গল্প থেকে ছবি হয়েছে−ফুলকুমার, নুরুল আলম আতিক নাটক বানিয়েছেন চতুর্থ মাত্রা। বুদ্ধদেব বসু সুত্রে জানি, বোদলেয়ারের নামের বানান সমকালীন লেখকেরা নির্ভুল লিখতে পারতেন না, তাঁর শবযাত্রায় লোক হয়েছিল খুব কম। শহীদুল হকের শেষকৃত্যে লোকের অভাব হবে না। কারণ, তিনি সরকারের সচিব ছিলেন, কিন্তু সমকালীন সাহিত্যিকেরা কজন উপস্িথত থাকতে পারবেন, আমি জানি না।কিন্তু এ কথা মেনে নিতে একদিন কারোরই অসুবিধা হবে না যে বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে শহীদুল জহিরের আসন চিরস্থায়ী।আমরা, তাঁর সাহিত্যের অনুরাগী ও মুগ্ধ পাঠকেরা, মাত্র ৫১ বছর বয়সে তাঁর এই হঠাৎ প্রস্থানকে মেনে নিতে পারছি না, তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর মতোই আমাদের ঘোরগ্রস্ত লাগছে, আমরা আকুল হয়ে তাঁর স্িথর হয়ে যাওয়া মুখের দিকে দেখি, কেবল শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই, তাঁকে আমরা খুঁজতে থাকি, তাঁর খোঁজে ঢুঁড়তে থাকি পাড়ামহল্লা−কিন্তু কোথায় পাব তাঁরে!

আনিসুল হক: লেখক ও সাংবাদিক।
ই-মেইল: anisulhoquem@yahoo.com

No comments: