Friday, March 28, 2008

শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

২৩ মার্চ মারা গেছেন শক্তিমান কথাশিল্পী শহীদুল জহির। এই নিভৃতচারী লেখক খুব কমই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় এ বছরের ৪ জানুয়ারি। সাক্ষাৎকারের একাংশ এখানে ছাপা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর কে রনি


__________________________

আর কে রনি: প্রথম লেখা গল্পের কোনো স্নৃতি মনে আছে?
শহীদুল জহির: ‘ভালোবাসা’ নামের একটা গল্প দিয়ে লেখালেখির শুরু। সত্তরের দশকে শহিদুল হক নামে লিখতাম।


রনি: আপনার আশপাশে কেউ লেখালেখি করতেন?
জহির: আশপাশের কারও লেখালেখি তো আসলে বিষয় না। বাবা লেখালেখি করতেন, সেটাও সিরিয়াস কিছু না। আমি কীভাবে লেখা শুরু করলাম, তার কোনো সুত্র নাই। কেন একজন লেখা শুরু করে, আর তার পাশের কেউ লেখে না−এর কোনো নিয়ম নেই।


রনি: আপনি তৈরি হওয়ার সময়টায় কাদের লেখা পড়েছিলেন?
জহির: তখন এত বই ছিল না। লেখালেখিও কম ছিল। প্রথমে পড়েছি বাংলাদেশের লেখকদের: শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক। পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়; বাইরের চেখভ। স্কুলে থাকতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পড়েছি।


রনি: পড়ালেখা কোথায় করেছেন?
জহির: ঢাকাতেই। মাঝখানে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আবার ঢাকায় ফিরে আসি। ইউনিভার্সিটিতে আমার বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।


রনি: ‘ভালোবাসা’ আপনার প্রথম গল্প। আপনার সর্বশেষ গল্প ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ পড়ে মনে হয়েছে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও লেখনভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, এটি আপনার লেখা।
জহির: হতে পারে। তবে আমার লেখায় কাঠামোগত যে পরিবর্তনটা এসেছে, তার শুরু জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে। পারাপার-এর গল্পগুলো অনেকটা গতানুগতিক কাঠামোর।


রনি: কাঠামোর কথা বলছি না, কিন্তু মৌলিকতা একটা আছে।
জহির: মৌলিকতার কথা আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে শেষ যে গল্পটার কথা বলছেন, সেটার সঙ্গে পারাপার-এর লেখাগুলোর একটা মিল হয়তো আছে। আরও দু-একটা লেখা হয়তো আপনি নিতে পারেন, যেমন ‘আমাদের বকুল’। এগুলো আসলে দার্শনিকভাবে এক। সচেতনভাবে আমার কোনো স্টাইল তৈরি হয়নি। স্টাইল তো মানুষের ব্যক্তিত্বেরই অংশ। মৌলিকতা নিয়ে আমি অত চিন্তিতও না। মৌলিকতা স্বীকার করলে বা না করলে কোনো সমস্যা নাই। আমি এমনিই গল্প লিখি। ভাষা যদি আমার তৈরি হয় তো হলো; না হলেও ক্ষতি নাই। কারণ, ভাষা তৈরির জন্য আমি সাহিত্য করি না; লেখার জন্য লিখি।


রনি: গল্প বলায় পূর্ববর্তী কোনো লেখকের শৈলী কি আপনাকে আকর্ষণ করে?
জহির: এটা হতে পারে যে বিভিন্ন গল্প পড়েই মানুষ গল্প বলার শৈলী তৈরি করে। তারপরে নিজের কোনো ভঙ্গি দাঁড়ায় বা দাঁড়ায় না। কাজেই বাংলা সাহিত্যের যে ঐতিহ্য, বিভিন্ন লোকের কাছ থেকেই আমার ভঙ্গি এসে থাকতে পারে।


রনি: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কি এখানে আনতে পারি?
জহির: আমার গল্পের ক্ষেত্রে যেটুকু এসেছে, সেটুকু ওয়ালীউল্লাহ্ ও সৈয়দ শামসুল হকের। গল্প বলায় ক্রিয়ার নিত্যবৃত্ত বর্তমানের যে প্রয়োগ, সেটা এ ধারারই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লেখার এ প্রভাব আমি সৈয়দ হকে দেখি। সেখান থেকেই বিশেষ এ শৈলীটি আমি নিজে দখল করি।


রনি: আপনার গল্পের চরিত্রগুলো কখনো কখনো দার্শনিক হিসেবে আসে−যেমন ‘ভালোবাসা’ বা ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’।
জহির: আসলে অভাবী শ্রেণীর লোকের কথাবার্তা তো, ফলে একই জিনিস। দার্শনিকতা কিছুটা হয়তো আছে। তবে ‘ভালোবাসা’ আর ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ গল্প দুটিকে আমি একই সমান্তরালে রাখতে চাই না। কারণ, দুইটার দার্শনিক ভিত্তি এক। পারাপার-এর গল্পগুলোতে মার্কসীয় একটি ভাবনা কাজ করেছিল। ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ও মনে হয় কিছুটা তা-ই। পরে আমি সেখান থেকে সরে এসেছি। কিন্তু গল্পের চরিত্র বা আবহ তৈরিতে ‘ভালোবাসা’র সঙ্গে ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’-এর একটা বড় পার্থক্য আছে। সেটা হচ্ছে ‘ভালোবাসা’ বাদে পারাপার-এর আর সব গল্পেই চরিত্রগুলো প্রতিবাদ করে। ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’ কিন্তু প্রতিবাদী না, আত্মসমর্পণের গল্প। আত্মসমর্পণ এই অর্থে যে এখানে জোর করে কিছু করা হয়নি। যখন বয়স কম ছিল, প্রতিবাদ বিষয়টা কাজ করেছিল। ‘কার্তিকের হিম জ্যোৎস্মায়’তেও মার্কসবাদের প্রভাব আছে, কিন্তু সেই উচ্চকিত বিষয়টি নেই। বাস্তব পরিণতি মেনে নেওয়া হয়েছে।


রনি: আপনার ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ গল্পটিকে কি জাদুবাস্তব গল্প বলা যায়?
জহির: বলতে পারেন। আমি তো এ রকম বিষয় ব্যবহার করি আগে থেকেই। জাদুবাস্তবতা নিয়ে কথা বলাটা খুবই স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে আমার বেলায়। আমি কথা অনেক সময়ই ভুলভাবে উদ্ধৃত করি। তাতে সমস্যা দেখা দেয়।


রনি: আপনার ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ গল্পে কাকগুলো কি কল্পপুরাণ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে?
জহির: লেখার সময় অত চিন্তা করি নাই। আসলে পাঠক আর লেখক−দুজনেই এক সমান। লেখার সময় লেখক স্বাধীনভাবেই লেখেন। এখন মেধাবী পাঠক নিজেও সৃজনশীলভাবে তার একটি সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি করে। তার অনেক কিছু মনে হয়। তার ভেতর থেকে অনেক দিকনির্দেশনা আসে। লেখক অনেক সময় ওসব চিন্তাই করেন না।


রনি: ‘সেই সময়’ গল্পটিকে কি আমরা প্রেমের গল্প বলব?
জহির: এটা প্রেমের গল্পই−যদিও সেখানে সময় আছে একটা। গল্পটির নাম প্রথমে ছিল ‘১৯৯২’, অর্থাৎ পত্রিকায় যখন সেটা ছাপা হয়েছে। তখন মারামারি, ধরাধরি, অস্িথরতা ইত্যাদি ছিল। আসলে বাংলাদেশের সব সময়ই এক। ১৯৯২ সালে যা, ২০০৮ সালেও তা-ই। নামটা তাই পাল্টে দিলাম।


রনি: আপনার সব গল্পই প্রায় মহল্লাভিত্তিক? ভুতের গলি নিয়ে অনেক গল্প আছে আপনার।
জহির: আমার জন্ন ভুতের গলিতে। ফলে জায়গাটা আমার পরিচিত। গল্প লিখতে হলে তো একটা আবহ তৈরি করতে হয়, একটা ভৌগোলিক পশ্চাদ্ভুমি লাগে। ভুতের গলি আমি ভালো চিনি। আরও মহল্লা ভালো চিনি। তো, ভুতের গলি আকর্ষণীয় মনে হয়।


রনি: ‘কাঁটা’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের, একে কি জাদুবাস্তবের গল্প বলা যায়?
জহির: এটা অতিবাস্তব। আমরা যে খুব সহজভাবে তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, ‘কাঁটা’ সে রকম গল্প না। এখানে সব ধর্মের লোকের প্রতি মহল্লার লোকদের সহানুভুতির উল্লেখ আছে; এসব বিষয়ে তাদের অপরাধবোধ ও অসহায়ত্বের কথা আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু−সবারই সমস্যা সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের অনেক নমস্য অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির গভীরে ঢুকলে আপনি দেখবেন, সাম্প্রদায়িকতা খুব গভীর একটা সমস্যা। আমার মনে হয়েছিল, এটা কীভাবে মনোজগতে থাকে, সেটা একটু দেখানো দরকার। এখানে কাঁটা শব্দটার ব্যবহার সেই অর্থে। এ গল্পের নাম আমি দুইবার বদলেছি। প্রথমে লিখেছি ‘কাঁটা’, পরে আবার লিখেছি ‘মনোজগতের কাঁটা’। কিছু লোকের আপত্তিতে পরে আবার পাল্টেছিলাম। তাদের মনে হয়েছে, বলে দেওয়ার দরকার নেই যে এটা মনোজগতের কাঁটা। কাঁটা বিভিন্ন রকমের আছে। পাঠক ঠিক করে নিক। পরে বইয়ের নাম দিয়েছিলাম জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এটা মূলত সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটি লেখা, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধেরও। এখানে যুদ্ধপূর্ব, যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর−তিন সময়ের কথাই আছে।


রনি: নকশাল আন্দোলন নিয়ে একটা গল্প আছে−‘ধুলোর দিনে ফেরা’। এটা তো অতিবাস্তব, নাকি বাস্তবই?
জহির: বাংলাদেশে তো তা-ই হয়েছে একসময়। নকশাল আন্দোলনে যারা গেছে, তাদের জীবনের পরিণতি তো করুণ। তাদের জন্য আমার যে অনুভুতি ও বেদনা, অনেকেরই সেটা আছে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। আগেই বলেছি, আমার লেখা মার্কসবাদে আচ্ছন্ন ছিল। এখনো সেটা আছে। প্রতিবাদী ভঙ্গি থেকে আমি সরে এসেছি, ওখান থেকে সরে আসা খুব মুশকিল। একবার যদি ওই দর্শন আপনার ভেতরে ঢোকে, আপনার তৈরি গল্পের রসায়নে ওই কেন্দ্র থেকে যায়। মার্কসবাদ মানে তো আসলে শুধু প্রতিবাদ না। এই গল্পে সত্তরের দশকের অবস্থাটা বলা হয়েছে। ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ গল্পে আবদুল ওহিদের ব্যর্থতার কারণ ওই আন্দোলনের ক্ষেত্রে অমানবিক একটি প্রসঙ্গ লালন করা।


রনি: এ গল্পে কিন্তু প্রেমও আছে।
জহির: প্রেম তো আছেই। কিন্তু আবদুল ওহিদ তো আর প্রেমের কারণে মরে নাই। সে পালিয়ে আসতে পারত। সে প্রেমের কারণে ফিরে আসে নাই। সে ফিরে এসেছে; যে কারণে সে গিয়েছিল, সেটা আর নাই। আশির দশকেই এটা বৈষয়িকভাবে শেষ হয়ে গেছে। এখন এটা বাংলাদেশের এক কোনায় চলে গেছে। এর অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু ওটা গুটিয়ে গেছে।


রনি: আপনার অন্য গল্পগুলো থেকে ‘চতুর্থ মাত্রা’ নানা কারণেই আলাদা। এতে আপনি ক্রিয়াপদের ভবিষ্যৎ রূপ ব্যবহার করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্ককার’-এও ক্রিয়াপদের একই ব্যবহার ছিল?
জহির: আমি ‘তেলেনাপোতা আবিষ্ককার’ পড়ি নাই। প্রেমেন্দ্র মিত্র কীভাবে কোন কাঠামোতে এটা ব্যবহার করেছেন, আমি জানি না। সৈয়দ শামসুল হকের মার্জিনে মন্তব্য-এ এই গল্পে ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। তাই জানতাম, তাঁর একটা গল্প আছে। কিন্তু এ নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তাও ছিল না যে লোকে বলবে, আমার ক্রিয়াপদের ব্যবহার প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছ থেকে এসেছে।


রনি: গল্পটিতে একটা দার্শনিকতা লক্ষ করা যায়।
জহির: আমি চাইছিলাম একেবারে গল্পহীনভাবে লিখতে। মানে, প্রায় কিচ্ছু না দিতে। গল্পের মধ্যে হাত দিলে কিছুই হাতে ঠেকবে না, এমন একটি গল্প লেখার ইচ্ছে ছিল। সেখান থেকে ‘চতুর্থ মাত্রা’ হয়েছে। গল্পে নায়ক কিছু করে না। তার কাজই মোটে দু-চারটা।


রনি: তার অর্থসংস্থান কীভাবে হয়? পুরোনো পত্রিকা বিক্রি করে কি চলে একটা মানুষের?
জহির: এর কোনো উত্তর নাই। হয়তো মাঝখানে সে চাকরি করে, এদিক-ওদিক যায়। হতে পারে। কিন্তু বাসায় যখন থাকে, তখন সে এগুলো করে।


রনি: এই গল্পে এই যে একটার পর একটা গ্লাস ভাঙা হয়, এটা কি প্রতীকী কোনো কিছু?
জহির: না, লোকটি যোগাযোগের চেষ্টা করে। কথাবার্তা বলা, সম্পর্ক তৈরি করা−এসব সামাজিক দক্ষতা তার কম। সে গৃহকেন্দ্রিক ও অলস। কিন্তু বাইরের জগতের সঙ্গে সে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে। আমি একজন পাঠকের ব্যাখ্যা আপনাকে বলছি। এ ব্যাখ্যাটা আমার ভালো মনে হয়েছে। গ্লাস ভেঙে ভেঙে সে বাইরের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে। কাগজ বিক্রি করে, যাতে কাগজওয়ালার সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকে। সে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এটা হতে পারে, আমি নিশ্চিত না।


রনি: এই যে লোকটার গ্লাস ভাঙা নিয়ে আপত্তি আসছে, তখন সে দুইটা ভাঙছে, তারপর তিনটা, তারপর চারটা−এর মধ্যে কি কোনো দার্শনিক বক্তব্য আছে?
জহির: মানুষের জীবনটাই তো দার্শনিকতাপূর্ণ। এটা মানুষের অতিকর্মতৎপরতার বিপক্ষে লেখা। মানুষের এত এত কর্মতৎপর হওয়ার দরকার কী? এত কাজ করে আমরা কী করব?


রনি: এটা কি হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হলো না?
জহির: হতে পারে। জীবনে কর্মতৎপর হওয়া এবং কিছু জিনিস অর্জন করাটাকে আমরা আশাবাদ বলি। কেউ হয়তো বলতে পারে, অর্জনের জন্য যে দৌড়, তাতে তো মানুষ এগোবে না। ব্যাপারটা এত সরল না। আপনি কি এভাবে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারবেন? এই দৌড়ের মধ্যে ব্যক্তিমানুষ খুব আরামে নাই।


রনি: আপনার প্রথম উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার বয়ান ও পটভুমি একেবারে আলাদা। এটি এক অনুচ্ছেদে লেখা একটি উপন্যাস?
জহির: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পড়ে আমার মনে হয়েছিল, কোথাও আমি এ রকম পড়িনি। এর মধ্যে চিত্রকর্মের একটা গড়ন আছে। পিকাসোর গুয়েরনিকার যে রকম একটা কিউবিক ফর্ম, একটা জিনিস ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া আছে। ঘোড়ার মাথা একদিকে, পা অন্যদিকে। কিউবিক শৈলীতে এককভাবে আপনি বিষয়টি আঁকছেন না। আমার মনে হয়েছে, একটি গল্পও যেভাবে খুশি বলা যায়। সেখানে দেখবেন, একটি কথা বলতে বলতে পরের লাইনে আরেকটি কথা চলে আসছে। গল্পের ছক এভাবে ভেঙে ফেলার কারণে আমি যাতায়াত করতে পেরেছি খুব দ্রুত।


রনি: এ উপন্যাসের কলেবর ছোট, কিন্তু অভিঘাত অনেক বিস্তৃত।
জহির: এটা ভেঙে লিখলে হয়তো আরও বড় হতো। বড় করতে চাই নাই কয়েকটা কারণে। প্রথমত, এর প্রয়োজন ছিল না। এটার প্রকাশ নিয়েও সমস্যা ছিল। যত বড় হতো, প্রকাশ করতেও তত কষ্ট হতো। আর গল্পের চাহিদার চেয়ে জোর করে বড় করার তো দরকার নেই। এর কাহিনীতে অনেক সময় পার হয়েছে। ১৯৮৫ সালে শুরু হয়েছে, একাত্তরে ফিরে গেছে, আবার ১৯৮৫-র পরে এসে গল্প শেষ হয়েছে। তিনটা কালস্তরে চলাচলের একটা ব্যাপার ছিল। গল্পের ভেতরে তো লেখককেও চলাচল করতে হয়। আমাদের সাহিত্যের পরিচিত কাঠামোয় এভাবে চলাচল করা কঠিন। একটা থেকে আরেকটা সময়ে গেলে, লেখক হিসেবে আমি দেখি, বর্ণনায় সমস্যা তৈরি হয়। তখন জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে এ কাজটা আমি করি। অনেকে এও বলেছে, এটা নাকি মার্কেজের লেখার অনুবাদ।


রনি: আপনার গল্পের চরিত্রগুলো উপন্যাসেও ফিরে ফিরে আসে। কেন?
জহির: নামগুলো প্রায় এক। এটা ইচ্ছাকৃত। হাজার হাজার নাম দেওয়ার দরকারটাই বা কী।


(সাক্ষাৎকারটি শহীদুল জহিরের ইস্কাটনের বাসায় প্রায় চার ঘণ্টা ধরে নেওয়া। ছাপার আগে তাঁকে দেখিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। সে কথা আর রাখা হলো না।−আর কে রনি)

.

.

No comments: