.
আটপৌরে বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারে সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র যখন কণ্টকাকীর্ণ তখন শুধু ভাষাবিষয়ক চিন্তকগণই নন, নানা পেশার সমাজমনস্ক চিন্তাশীল ব্যক্তিও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। ৬ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানমের ‘টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার’ শিরোনামে লেখায় এ ধরনের উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে।
ড. মেহতাব খানমকে ধন্যবাদ এ কারণে যে, তিনি আটপৌরে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরে লিখেছেন: ‘একটি মানুষ যখন শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলে নিজেকে কোথাও উপস্থাপন করে, তখন নিঃসন্দেহে সে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেটি তখন তার আত্মবিশ্বাসকেও কিন্তু অনেক বাড়িয়ে দেয়।’ আমরা এতদিন সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র ও প্রচার মাধ্যমে আটপৌরে বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার না করার জন্য বলে এসেছি ভাষার ভিত্তি, বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার কথা চিন্তা করে। এখন বোঝা গেল, এ শুধু ভাষার ভিত্তি, বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার প্রশ্ন বা ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেও যুক্ত।
ইদানীং কিছু গল্প-উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে ব্যাপকভাবে আটপৌরে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। টেলিভিশন নাটক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে এর ব্যবহার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এ প্রসঙ্গে আজ চারদিক থেকে সরব না হলে উপায় নেই। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, কর্পোরেট পুঁজি এবং বিদেশি লগ্নিকারী কথিত বড় কিছু প্রতিষ্ঠান টেলিভিশনের এসব নাটক ও বিজ্ঞাপনের অর্থ জোগানদাতা বা স্পন্সর। এসব অর্থ জোগান বা বিনিয়োগের উদ্দেশ্য সুদুরপ্রসারী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন আমাদের দেশের কিছু মেধাবী মানুষ; যারা চমৎকার গল্প বানাতে পারেন, বিজ্ঞাপন তৈরি করতে পারেন, বলতে পারেন আরও ভালো। তাঁদের কেউ বলছেন, ‘আমরা অভিনয় থেকে অভিনয়টা দুর করতে চাই।’ এ নতুন কোনো কথা নয়। ‘থার্ড থিয়েটার’-এর জন্নই হয়েছিল ‘জীবন থেকে উঠে আসে নাটক’-এর ধারণা নিয়ে। নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং অভিনয়ে কোনো কৃত্রিমতাকে প্রশ্রয় দিতেন না এর উদ্যোক্তারা। তাই বলে ভাষা ব্যবহারে তাঁরা আটপৌরে ছিলেন না; ঘরে ব্যবহারের শব্দ বা বাক্যরাজির সমাহারে তাঁদের সৃষ্টিকে সীমিত ও কণ্টকিত করেননি। ‘ওর মেসেজটা পাইয়াই আমারে ফাটাফাটি কইরা একটা ফোন মারবি, ঠিক আছে?’ বা ‘সকালে হ্যাব্বি নাশতা সাটাইছি, দুপুরে ক্ষুধাই লাগতাছে না।’ এ জাতীয় ভাষায় নাটকের সংলাপ রচনা বা বিজ্ঞাপনে বাক্য ব্যবহার ইদানীং টেলিভিশনের পর্দায় বড় কোম্পানিগুলোর স্পন্সর বা অর্থায়নে যদি হতেই থাকে, তবে বুঝতে হবে বাংলা ভাষার ‘মান’ তো থাকবেই না, ‘জান’ নিয়েও টানাটানি শুরু হবে।
অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে দেশপ্রেমকে অতিমাত্রায় জড়িয়ে দেন এবং বলেন এ রকম: ‘প্রমিত বাংলা বলে কিছু নেই। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে তা আসলে কলকাতার ভাষা। আমরা স্বাধীন দেশের কথ্য ভাষায় এসব সাহিত্য লিখি বা বিজ্ঞাপন বানাই।’ এ ধরনের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা মনে মনে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াকেই লালন করেন এবং তা সব অর্থেই সংকীর্ণ। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে, তা কলকাতার ভাষা নয়। কলকাতার যে ভাষারূপ তা সাবেক রাজধানী শহরের এক জাতীয় সংমিশ্রিত বাংলা। সাধুরীতির পরিবর্তে লিখিত গদ্যে চলিত রীতির ব্যবহার প্রচলনের সময়ই অর্থাৎ প্রায় শতবর্ষ আগে ভাষাচিন্তক ও সংস্কৃতিবোদ্ধারা অবিভক্ত বঙ্গের নানা অঞ্চলের ভাষা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা হবে এর আদর্শ। এরই ব্যবহারিক রূপ আজকের প্রমিত বাংলা। এই প্রমিত বাংলা বাংলাদেশেরও ভাষারূপ। কেননা, নদীয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা আজকের বাংলাদেশের তিনটি জেলা। ‘কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে’র বলে এই প্রমিত রূপকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। ড. মেহতাবও লিখেছেন: ‘যে দেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সে দেশের শিশুরা শুদ্ধ উচ্চারণে বলা প্রমিত বাংলার সঙ্গে অশুদ্ধ উচ্চারণকে পার্থক্য করতে শিখুক−সেটি আমরা চাই।’ এ রকম শুদ্ধ প্রত্যাশাই আজ জরুরি।
উনিশ শতকে শহর কলকাতায় যে ‘বাবু-কালচার’ তৈরি হয়েছিল এবং এর প্রভাব পড়েছিল বাংলা ভাষাতে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তেমনি শহর ঢাকাকে কেন্দ্র করে গুলশান-বারিধারার মতো স্থানে বাস করা অঢেল বিত্ত-বৈভবসম্পন্ন মানুষের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের ‘সাহেবি-কালচার’ তৈরি করেছে। তাদের ব্যবহূত আটপৌরে এবং মিশ্রভাষার প্রভাব এসে পড়ছে আমাদের ভাষায়। এ ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারই দেশপ্রেম প্রদর্শনের পথ, এ কথা সত্য নয়। কিছু গল্প-উপন্যাসেও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে এ জাতীয় ভাষার সীমিত ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হলেও এর যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে কাম্য নয়, অন্যান্য মাধ্যমেও অনুচিত। শিল্পীর ‘অধিকার’ বলে এই যথেচ্ছাচারে যাঁরা নিমজ্জিত হতে চান, তাঁরা কি জানেন, শিল্পীর শুধু ‘অধিকার’ নয়, তাঁর ‘দায়িত্ব’ও আছে!
ড. মেহতাব খানমকে ধন্যবাদ এ কারণে যে, তিনি আটপৌরে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরে লিখেছেন: ‘একটি মানুষ যখন শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলে নিজেকে কোথাও উপস্থাপন করে, তখন নিঃসন্দেহে সে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেটি তখন তার আত্মবিশ্বাসকেও কিন্তু অনেক বাড়িয়ে দেয়।’ আমরা এতদিন সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র ও প্রচার মাধ্যমে আটপৌরে বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার না করার জন্য বলে এসেছি ভাষার ভিত্তি, বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার কথা চিন্তা করে। এখন বোঝা গেল, এ শুধু ভাষার ভিত্তি, বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার প্রশ্ন বা ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেও যুক্ত।
ইদানীং কিছু গল্প-উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে ব্যাপকভাবে আটপৌরে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। টেলিভিশন নাটক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে এর ব্যবহার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এ প্রসঙ্গে আজ চারদিক থেকে সরব না হলে উপায় নেই। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, কর্পোরেট পুঁজি এবং বিদেশি লগ্নিকারী কথিত বড় কিছু প্রতিষ্ঠান টেলিভিশনের এসব নাটক ও বিজ্ঞাপনের অর্থ জোগানদাতা বা স্পন্সর। এসব অর্থ জোগান বা বিনিয়োগের উদ্দেশ্য সুদুরপ্রসারী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন আমাদের দেশের কিছু মেধাবী মানুষ; যারা চমৎকার গল্প বানাতে পারেন, বিজ্ঞাপন তৈরি করতে পারেন, বলতে পারেন আরও ভালো। তাঁদের কেউ বলছেন, ‘আমরা অভিনয় থেকে অভিনয়টা দুর করতে চাই।’ এ নতুন কোনো কথা নয়। ‘থার্ড থিয়েটার’-এর জন্নই হয়েছিল ‘জীবন থেকে উঠে আসে নাটক’-এর ধারণা নিয়ে। নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং অভিনয়ে কোনো কৃত্রিমতাকে প্রশ্রয় দিতেন না এর উদ্যোক্তারা। তাই বলে ভাষা ব্যবহারে তাঁরা আটপৌরে ছিলেন না; ঘরে ব্যবহারের শব্দ বা বাক্যরাজির সমাহারে তাঁদের সৃষ্টিকে সীমিত ও কণ্টকিত করেননি। ‘ওর মেসেজটা পাইয়াই আমারে ফাটাফাটি কইরা একটা ফোন মারবি, ঠিক আছে?’ বা ‘সকালে হ্যাব্বি নাশতা সাটাইছি, দুপুরে ক্ষুধাই লাগতাছে না।’ এ জাতীয় ভাষায় নাটকের সংলাপ রচনা বা বিজ্ঞাপনে বাক্য ব্যবহার ইদানীং টেলিভিশনের পর্দায় বড় কোম্পানিগুলোর স্পন্সর বা অর্থায়নে যদি হতেই থাকে, তবে বুঝতে হবে বাংলা ভাষার ‘মান’ তো থাকবেই না, ‘জান’ নিয়েও টানাটানি শুরু হবে।
অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে দেশপ্রেমকে অতিমাত্রায় জড়িয়ে দেন এবং বলেন এ রকম: ‘প্রমিত বাংলা বলে কিছু নেই। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে তা আসলে কলকাতার ভাষা। আমরা স্বাধীন দেশের কথ্য ভাষায় এসব সাহিত্য লিখি বা বিজ্ঞাপন বানাই।’ এ ধরনের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা মনে মনে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াকেই লালন করেন এবং তা সব অর্থেই সংকীর্ণ। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে, তা কলকাতার ভাষা নয়। কলকাতার যে ভাষারূপ তা সাবেক রাজধানী শহরের এক জাতীয় সংমিশ্রিত বাংলা। সাধুরীতির পরিবর্তে লিখিত গদ্যে চলিত রীতির ব্যবহার প্রচলনের সময়ই অর্থাৎ প্রায় শতবর্ষ আগে ভাষাচিন্তক ও সংস্কৃতিবোদ্ধারা অবিভক্ত বঙ্গের নানা অঞ্চলের ভাষা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা হবে এর আদর্শ। এরই ব্যবহারিক রূপ আজকের প্রমিত বাংলা। এই প্রমিত বাংলা বাংলাদেশেরও ভাষারূপ। কেননা, নদীয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা আজকের বাংলাদেশের তিনটি জেলা। ‘কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে’র বলে এই প্রমিত রূপকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। ড. মেহতাবও লিখেছেন: ‘যে দেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সে দেশের শিশুরা শুদ্ধ উচ্চারণে বলা প্রমিত বাংলার সঙ্গে অশুদ্ধ উচ্চারণকে পার্থক্য করতে শিখুক−সেটি আমরা চাই।’ এ রকম শুদ্ধ প্রত্যাশাই আজ জরুরি।
উনিশ শতকে শহর কলকাতায় যে ‘বাবু-কালচার’ তৈরি হয়েছিল এবং এর প্রভাব পড়েছিল বাংলা ভাষাতে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তেমনি শহর ঢাকাকে কেন্দ্র করে গুলশান-বারিধারার মতো স্থানে বাস করা অঢেল বিত্ত-বৈভবসম্পন্ন মানুষের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের ‘সাহেবি-কালচার’ তৈরি করেছে। তাদের ব্যবহূত আটপৌরে এবং মিশ্রভাষার প্রভাব এসে পড়ছে আমাদের ভাষায়। এ ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারই দেশপ্রেম প্রদর্শনের পথ, এ কথা সত্য নয়। কিছু গল্প-উপন্যাসেও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে এ জাতীয় ভাষার সীমিত ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হলেও এর যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে কাম্য নয়, অন্যান্য মাধ্যমেও অনুচিত। শিল্পীর ‘অধিকার’ বলে এই যথেচ্ছাচারে যাঁরা নিমজ্জিত হতে চান, তাঁরা কি জানেন, শিল্পীর শুধু ‘অধিকার’ নয়, তাঁর ‘দায়িত্ব’ও আছে!
ড. সৌমিত্র শেখর: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১১ নভেম্বর, ২০০৭
No comments:
Post a Comment