Thursday, November 15, 2007

প্র তি ক্রি য়া: ভাষা বিতর্কের আগুনে আরও দুই ফোঁটা ঘি

.
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে, নাটকে ও সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটি উদ্বেগের কথা উঠেছে। মেহতাব খানম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সৌমিত্র শেখরকে ধন্যবাদ জানাই বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত জানানোর জন্য। মেহতাব খানমের উত্থাপিত প্রসঙ্গটি ছিল মূলত টেলিভিশন নাটকের সংলাপ নিয়ে। ফলে আশা ছিল নাট্যজনদের কেউ মতামত দেবেন এবং দেখলাম সরয়ার ফারুকী সেটা দিয়েছেনও। ফলোআপ হিসেবে ১১ নভেম্বর প্রথম আলোয় সৌমিত্র শেখর তাঁর আলোচনাটিকে শুধু নাটকের সংলাপে সীমিত রাখেননি, বরং সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চায় আটপৌরে ভাষার ‘যথেচ্ছ’ অনুপ্রবেশ নিয়েও নিজের উদ্বেগের কথা বলেছেন।
টেলিভিশন নাটকে, সিনেমায় বা সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার অনুপ্রবেশকে ‘যথেচ্ছ’ মনে হওয়ার কারণ কী? সরয়ার ফারুকীর বক্তব্যে তো মনে হচ্ছিল যে, আটপৌরে ভাষার প্রয়োগ নিয়ে তাঁদের সুনির্দিষ্ট চিন্তা রয়েছে। কার ইচ্ছায় ও চিন্তায় তাহলে আটপৌরে ভাষা ‘মানভাষা’য় প্রবেশাধিকার পাবে? সৌমিত্র শেখর বলছেন, সেটা শতবর্ষ আগের অবিভক্ত বাংলার ভাষাচিন্তক ও সংস্কৃতি বোদ্ধাদের ইচ্ছায় বা সিদ্ধান্তে। তাঁরা বহু গবেষণা করে নদীয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের বাংলাকে প্রমিত বাংলা বলে ঠিক করে গিয়েছিলেন। তাঁদের সেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের পর ১০০ বছর গত হলো, অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হলো এবং দুই বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা দুই মেরুর দিকে ধাবমান হলো। অল্প কিছু সাহিত্য ও সামান্য কিছু জীবনমুখী গান ছাড়া আর কোন বিষয়টা দুই বাংলার ভোক্তারা এখন শেয়ার করে বলা মুশকিল। একদা অবিভক্ত, কিন্তু বর্তমানে পরস্পর থেকে নানাভাবে দুরে সরতে থাকা দুই বাংলা চিরকাল একইভাবে ভাষা ব্যবহার করতে থাকবে, এটা কেমন দাবি? রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার কারণেই বিশ্বায়নের চাহিদা দুই বাংলার কাছে দুই রকম, যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ একটা বড় বহুজাতিগোষ্ঠীভিত্তিক রাষ্ট্রের অংশ আর পূর্ববঙ্গ নিজেই একটা জাতিরাষ্ট্র। যে বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ আজ সাহিত্য, সাংবাদিকতা কিংবা টেলিভিশন নাটক করছে, তার মধ্যে হিন্দি বা ‘হিংলিশ’ ভাষার দাপট কী রকম আছে? কতটা প্রমিত আজ প্রমিত বঙ্গের বাংলা? প্রমিত বাংলার জন্য শতবর্ষ আগে বেঁধে দেওয়া সেই মানদন্ড থেকে একা পূর্ববাংলাই সরে আসছে, এটা বোধ হয় ঠিক নয়।
মেহতাব খানমের উদ্বেগ তবু সময়োচিত, ঢাকাই উচ্চবিত্তের ‘ডিজুস’ কালচার দিয়ে আমাদের কল্পনার আবহমান বাংলা নিয়ন্ত্রিত হোক সেটা তিনি বা সরয়ার ফারুকী কেউই চান না। ফারুকীও তাঁর লেখায় সেই উদ্বেগের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং ‘জাতীয়’ মিডিয়াকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে উত্তরণের পথ বাতলেছেন। কিন্তু ভাষা মূলত ক্ষমতা-সম্পর্কের দ্যোতক এবং সে কারণেই এই ধরনের উদ্বেগ মূলত মধ্যবিত্তের, যেহেতু মধ্যবিত্ত এটা ভাবতে পছন্দ করে যে তারাই ‘জাতীয়’ সংস্কৃতির মুখ্য আধিকারিক। এই যুদ্ধ দৃশ্যত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যকার একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ, যেখানে তাদের উভয়ের কুরুক্ষেত্র হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নিজ নিজ শক্তিশেল তো আছেই। উচ্চবিত্তের টাকা থাকলেও মধ্যবিত্তের আছে লোকবল আর উচ্চকিত হওয়ার নৈতিক অধিকার। মিডিয়াব্যক্তিত্ব সরয়ার ফারুকী যেভাবে মেহতাব খানমের উদ্বেগকে সমর্থন জানিয়েছেন তা দেখে মনে হচ্ছে এই কৌরব-পান্ডবের যুদ্ধে তিনি যেন কর্ণ! মন মধ্যবিত্তের দিকে, কাজ করছেন উচ্চবিত্তের ভাষায়!
বলা বাহুল্য, নিম্নবিত্ত সমাজ এই যুদ্ধে উপেক্ষিত। গরিব রিকশাওয়ালার আবার ভাষা কী? সে তো আমাদেরই বেঁধে দেওয়া ভাষাব্যবস্থায় চলবে, নাকি? অথচ, আমরা খেয়াল করি না যে, ‘ডিজুস’ বাংলার আগেই নিম্নবিত্তের নিজস্ব বাংলা প্রমিত বাংলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদের মিডিয়ায়। তাদের মিডিয়া? কেন, দেখছেন না সেই মিডিয়ার দাপটে আমাদের নামী ব্যান্ডশিল্পীদের কাঁধে গামছা, পরনে জিনসের বদলে আলখাল্লা, আর মমতাজকেও দেখুন! সবচেয়ে বেশি অ্যালবামের গায়িকা হিসেবে ইতিমধ্যেই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠেছে তাঁর। হ্যাঁ, অডিও ক্যাসেটই নিম্নবিত্তের মিডিয়া এবং এই কেন্দ্রাতিগ মিডিয়াটি কোনো রকম বিজ্ঞাপনী প্রশ্রয় ছাড়াই বর্তমানে দেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল মিডিয়াগুলোর একটা। খেয়াল করে শুনে দেখুন, সেখানেও এক রকমের বাংলার চল আছে, যা নিম্নবিত্ত বা নগর-গরিবের বাংলা। আমার প্রস্তাব, এই ধারার বাংলাকেও বর্তমান তর্কে শামিল করা হোক। তাকে পাশ কাটানোর একাডেমিক আভিজাত্য থেকে মুক্ত হোক ঢাকাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত।
এবার সাহিত্যের ভাষা প্রসঙ্গে আসা যাক, যেহেতু সৌমিত্র শেখর সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর ঔচিত্যবোধ প্রখর, আটপৌরে বাংলায় রচিত সাহিত্য জাতীয় প্রচারমাধ্যমে প্রচার অনুচিত বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু কেন? ঢাকাই মিশ্র আটপৌরে বাংলা শেষ বিচারে এক ধরনের আঞ্চলিক বাংলাই বটে। মেহতাব খানমের আপত্তির কারণ তো বোধগম্য, তিনি আজকালকার টেলিভিশন-দেখা ছেলেমেয়েদের ‘শুদ্ধ’ বাংলায় কথা বলার ক্ষেত্রে নাটকের ভাষাকে প্রতিবন্ধক ভাবছেন। কিন্তু আঞ্চলিক বাংলায় সাহিত্য তো নতুন কিছু নয়। তাহলে এখন আপত্তি উঠছে কেন? বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করি।
প্রথাগত ধারণাটি হলো, আঞ্চলিক বাংলা ততক্ষণ পর্যন্ত ‘বৈধ’, যতক্ষণ তা উদ্ধৃতি ও বন্ধনী চিহ্নের মধ্যে থাকে। যেমন, সংলাপ আঞ্চলিক হতে পারে, যদি সেই সাহিত্য কোনো এক আঞ্চলিক জীবনযাত্রার আখ্যান হয়। কিন্তু কথকের বা বর্ণনাকারীর ভাষা হতে হবে অবশ্যই ‘মান ভাষা’, যেহেতু তিনি সাহিত্যিক হিসেবে বাইডিফল্ট মধ্যবিত্ত। তিনি ‘শুদ্ধ’ বাংলায় চাষাভুষার জীবন নিয়ে আলেখ্য রচনা করবেন, আর সততার খাতিরে চাষাভুষার মুখের ভাষা সে রকমই বহাল রাখবেন। তাতে আপত্তি নেই। আপত্তিটা তখনই বাঁধে যখন সাহিত্যের বর্ণনাকারীর ভাষা প্রমিত বাংলা থেকে বিচ্যুত হয়। এ যেন সাহিত্যিকের এবং সাহিত্য-বিচারকের কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে মধ্যবিত্তের আধিপত্যকে খারিজ করে দেওয়ার শামিল! সাহিত্যে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার নিয়ে আপত্তির জায়গাটা, আমার ধারণা, এখানেই।
ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কেন্দ্রে বিবেচনা করেই সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান এবং নন্দনতত্ত্বের প্রতীকগুলো গড়ে উঠেছে। এখন কোনো সাহিত্যিক যদি সেই নির্মাণকে মান্য না করেন, তবে আশঙ্কার ঘণ্টী স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই বাজবে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ তারাই মানদন্ডের রক্ষক এবং এর মাধ্যমে সহজেই তাদের আধিপত্য ধরে রাখা যায়। কিন্তু এটা আমরা ভাবি না যে প্রাতিষ্ঠানিক মধ্যবিত্ত ভাবনা আর সমাজে বিদ্যমান মধ্যবিত্ত ভাবধারা এক নয়। আবার এটাও হাস্যকরভাবে মনে করি যে, কেবল মধ্যবিত্তই চিরকাল অপরাপর শ্রেণীর পক্ষে শিল্প-সাহিত্য করবে। কিন্তু ভাষা তো প্রবহমান, সে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণীগুলোর ক্ষমতা-সম্পর্কের দর্পণও বটে। তাকে ‘প্রমিত’ বাংলা নাম দিয়ে শতবর্ষ আগের কোনো সমঝোতার ঘেরাটোপে আটকানোর চেষ্টা অর্থহীন। কীভাবে অর্থহীন ফারুকী সেটা সংক্ষেপে বলেছেন। আমার বলার বিষয় হলো, যে বিচারে আমরা সাহিত্যের চরিত্রগুলোর মুখে আঞ্চলিক ভাষাকে বৈধ ভাবি, সেই একই বিচারে বর্ণনাকারীর আঞ্চলিক ভাষাকেও বৈধ ভাবতে পারি। সাহিত্যিকের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি থেকে মধ্যবিত্তকে রেহাই দেওয়ার দরকার কিছু আছে, কারণ মুষ্টিমেয় কিছু বাদে মধ্যবিত্তের একটি বিরাট অংশ কিন্তু সাবঅল্টার্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বর্তমানের সাহিত্যিক মধ্যবিত্ত কিন্তু সেই উদ্বেগ থেকে বিকশিত হচ্ছে। ফলে, জীবনের প্রয়োজনে, হরহামেশাই তাকে প্রমিত বাংলার বাউন্ডারি টপকাতে হচ্ছে।

সুমন রহমান: গল্পকার। ১৫ নভেম্বার, ২০০৭
.

Tuesday, November 13, 2007

প্র তি ক্রি য়া: ভাষার আগুনে ঘি এবং বাংলার ভবিষ্যৎ

.
প্রথম আলোর ৬ নভেম্বর সংখ্যায় অধ্যাপক মেহতাব খানম নাটকের ভাষা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর ৮ নভেম্বর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সে ভাষার ‘আগুনে দু ফোঁটা ঘি’ ঢালার চেষ্টা করেছেন। ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার কিছু বলার আছে বা বলা উচিত বোধ থেকেই এ লেখা। বিতর্কটা অনেকদিন থেকেই চলছে, বিশেষ করে একান্নবর্তী ধারাবাহিক এবং ব্যাচেলর মুক্তি পাওয়ার পর। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো এবং এইচএসবিসির উদ্যোগে যে ‘ভাষা প্রতিযোগ’ হয় প্রতিবছর, সেখানে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই যে অভিযোগ উপস্থাপন করে, তা হচ্ছে শহুরে কথ্য ভাষা বাংলা নাটকে প্রয়োগ করা উচিত কি না? এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি শিল্পের দায়বোধ, অন্যটি ভাষাপ্রেম বা ভাষার পরিবর্তন বিষয়ে উদ্বেগ। মেহতাব খানম দ্বিতীয়টি নিয়ে লিখেছেন, ফারুকী প্রথমটি নিয়ে, আমি দুটি বিষয়কে ধরে একটু অন্য বিষয়ে যেতে চাই।
উনিশ শতকে বাংলা নাটকে (প্রহসনে) মধুসুদন দত্ত যখন মুখের ভাষা প্রয়োগ (মূলত আঞ্চলিক বাংলা) করেন তাঁর বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ এবং একেই কি বলে সভ্যতায়, তখন সমালোচকেরা নিন্দার কাঁটা দিয়ে কম খোঁচাননি। কিন্তু পরে শিল্পবোদ্ধারা এর স্বীকৃতি দেন। এমনকি আজও মধুসুদনের সে কাজকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। একই প্রসঙ্গে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের কথাও উল্লেখ করা যায়। সে হিসেবে আমাদের টিভি নাটকে যে নাগরিক বাংলা বা শহুরে কথ্য ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে, তা কিন্তু এসব নাটকের লেখক বা নির্মাতাদের তৈরি কোনো কৃত্রিম ভাষা নয়। আইছি, খাইছি জাতীয় ক্রিয়াপদ বহুল ব্যবহূত। নাট্যকার বা নির্মাতারা চরিত্রগুলোকে বাস্তবানুগ করার লক্ষ্যেই তাদের মুখে এ ধরনের সংলাপের ব্যবহার দেখাচ্ছেন। আবার এই একই চরিত্র যখন চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যায়, তখন প্রমিত বাংলায় কথা বলে। শিল্প এবং ভাষার বিচারের দিক থেকে এটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করি না।
আমরা ভাষার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি, আমাদের শিশুরা প্রমিত বাংলা আয়ত্ত করুক তা আমরা সবাই চাই। তা ছাড়া প্রমিত বাংলা আত্মবিশ্বাসেরও জন্ন দেয়। কিন্তু আকাশসংস্কতি, তথ্যপ্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের এই সময়ে তরুণ প্রজন্েনর বদলাবেই, আগের প্রজন্েনর মতো থাকবে না, তাই তাদের ভাষাও বদলে যাবে।
ব্যক্তি মানুষ ভাষাকে বদলাতে পারে না, ভাষা বদলে যায় সমাজের দ্বারা; একদিনে নয় অনেক দিনে; ব্যবহারে, অভ্যাসে ধীরে ধীরে বদলায়। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে মুখের ভাষায় লেখা হতো না। মুখে ছিল চলিত আর সাহিত্যের ভাষা ছিল সাধু। এই সাধু ছেড়ে মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য প্যারিচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ কম গালমন্দ শোনেননি। পরে সবুজপত্র (১৯১৪) খ্যাত প্রমথ চৌধুরী মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সাধু ভাষা ছেড়ে চলিত ভাষায় লিখেছিলেনশেষের কবিতা এবং তাঁর উপন্যাসের মধ্যে এটি অধিক পঠিত ও জনপ্রিয়। প্রমথ চৌধুরী ভাষাকে মানুষের মুখ থেকে কলমে নিতে চেয়েছিলেন (উল্টোটা করতে গেলে মুখে কালি লাগে) বিশ শতকে এসে ধীরে ধীরে সাধু ছেড়ে চলিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের ভাষা আর এ কালে এই একুশ শতকে সাধু ভাষার স্থান হয়েছে লাইব্রেরি কিংবা জাদুঘর। এভাবেই ভাষার বদল ঘটে।
একুশ শতক শেষে পৃথিবীতে কয়টি ভাষা টিকে থাকবে এই জরুরি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করে ভাষাবিজ্ঞানীরা তিনটি ভাষার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন−এগুলো হচ্ছে চীনা, ইংরেজি ও হিন্দি। হয়তো আরও কিছু ভাষা টিকবে এবং সে তালিকায় বাংলা থাকবে কি না সে অপেক্ষার বিষয়। কিন্তু এ কালে যে বাঙালির সন্তান বাংলা ভাষার লোকসাহিত্য, রূপকথা পাঠ ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমা হ্যারি পটারের স্বপ্নে বিমোহিত হচ্ছে মেহতাব খান ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এ আশঙ্কার সঙ্গে যেমন আমি একমত, তেমনি আমাদের প্রিয় বর্ণমালা অ-আ-ক-খ ছেড়ে রোমান হরফে (ইংরেজি নয়) ডিজুসীয় বাংলার প্রচলন বাড়ছে এবং কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আমাদের এ সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কি আমাদের কিছুই করণীয় নেই? গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের একটা সামাজিক দায় ও ভাষাপ্রেম থাকা উচিত, যা দিয়ে সে রোমান হরফে বাংলা লেখা ছাপা যাবে না ঘোষণা দিতে পারে।
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভাষা তার স্বাভাবিক নিয়ম ও গতিতে চলে, পরিবর্তিত হয়, বহতা নদীর মতো এগিয়ে চলে। কখনো গ্রহণ করে, কখনো বর্জন করে। ভাষিক সমাজে বসবাসরত মানুষ নিজের অজান্তেই পাল্টে ফেলে ভাষা (কখনো কখনো রাষ্ট্রের উদ্যোগে সচেতনভাবেও ভাষায় পরিবর্তন আনা হয়−বাহাছা মালয়েশিয়া যার উদাহরণ)। ভবিষ্যতে আমাদের নাগরিক সমাজ যদি প্রমিত বাংলা ছেড়ে ‘আইছি’ (আসিয়াছি>এসেছি>আইছি) ‘গেছি’ জাতীয় ভাষা প্রয়োগ শুরু করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভাষা মূলত বেঁচে থাকে মানুষের মুখে, মুখের ভাষাকে নিয়ম বেঁধে ঠেকানো যায় না। তাহলে প্রাকৃত নয় মৃত সংস্কৃতই টিকে থাকত। শুধু বাংলা কেন সব ভাষাতেই কি পরিবর্তন ঘটছে না। আমাদের ভাষাপ্রেম আছে, থাকবে, বদলটাকেও স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে।

সৌরভ সিকদার: শিক্ষক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৩ নভেম্বর ২০০৭
.

Monday, November 12, 2007

প্র তি ক্রি য়া: আটপৌরে ভাষায় ঘৃতাহুতি

.
গত ৬ নভেম্বর প্রথম আলোয় মেহতাব খানমের আটপৌরে ভাষার ওপর লেখাটা পড়েছি। চলচ্চিত্র, রেডিও, টিভি, বিজ্ঞাপন, ইন্টারনেট, মুঠোফোন ইত্যাদিতে ইদানীং যে ভাষায় কথাবার্তা বলা শুরু হয়েছে তাতে একশ্রেণীর উদ্ভাবক ভাবছেন−এটাই আমাদের বাংলাদেশিদের মিডিয়া-সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিত। তাহলে বোধ হয় পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা থেকে আমাদেরটা আলাদা করা যাবে। আমাদের দেশের খুবই প্রতিভাবান কয়েকজন তরুণ কবি ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা এ ভাষার উদীয়মান প্রতিভু বা পথিকৃৎও বলা চলে। আট-নয় বছর আগে ইন্টারনেটে ই-ম্যাগাজিন চালু করে এসব কবি-সাহিতিকের কাব্যচর্চার পাশাপাশি চিঠিপত্রের ভাষাতেও আটপৌরে ভাষার প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাঁদের কেউ প্রতিষ্ঠিত দৈনিকে কবিতা লেখেন ‘বিল্লাল হালিম খাইতাছে’ শিরোনামে। কেউ চিঠি লেখেন ‘প্রিয় অমুক, কী করতাছস আইজকাল? লেখা কি ছাইড়া দিলি? তয় যোগাযোগডা চালাইয়া যাছ’।
একটা নতুন ধারার ভাষা প্রবর্তনের জন্য এসব ভাষার ব্যবহার তাঁরা মনে হয় সচেতনভাবেই আরোপের চেষ্টা করছেন। তাঁরা হয়তো বলতে পারেন বিদ্যাসাগরীয়-বঙ্কিমী রীতি কি আমরা এখনো অনুসরণ করি? রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র পর্যন্ত তাঁদের প্রথম দিককার গল্প-উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীর মুখের সংলাপে ‘উহার কান মলিয়া দাও’ ধরনের সাধু ভাষা ব্যবহার করেছেন। পরে গল্প-উপন্যাসের ভাষা সাধু রীতির হলেও যুগের প্রয়োজনে সংলাপের ভাষা চলিত রীতিতে পর্যবসিত করতে পেরেছিলেন, যা বিদ্যাসাগরের কাছে অভাবনীয় ছিল। তো এত যুগ পর আমরা যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই যদি শিল্প-সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার করা যায়, তাহলে ক্ষতি কী−ভাবছেন তরুণ বৈপ্লবিকেরা। তরুণ চলচ্চিত্রকারেরা চলচ্চিত্রে এ ধরনের ভাষার ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন। তাঁরা বলতে চান অভিনয় আর যাত্রাপালার মতো হবে না। অভিনয় হবে স্বাভাবিক জীবনাচরণের মতো। আমরা পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যেভাবে কথা বলি, নাটকের ভাষাও হবে সে রকমই। তাহলে তা দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি পাবে।
কেউ কেউ ঢাকাশ্রয়ী একধরনের ভাষা আনছেন, অন্যদিকে কেউ কেউ আনছেন কুষ্টিয়া-যশোরের ভাষা। এখন যদি এক পক্ষ দাবি করে, মিডিয়ার ভাষা হবে বৃহত্তর খুলনা-রাজশাহী অঞ্চলের−অন্য দল বলে, না, ঢাকা অঞ্চলের। তাহলে কোন ভাষাকে মিডিয়া-প্রযোজ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে? ‘কানতাছস ক্যা’, ‘কই যাইতাছ’ বা ‘ক্যামনে বুঝুম’−এসব ভাষা যেমন কেবল ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনি ‘কনে যাচ্ছ’, ‘কিরাম কইরি বুইজব’ ইত্যাদি ভাষাও মিডিয়া, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ভাষা হতে পারে না। সিনেমা-নাটকে রাজশাহী-খুলনা অঞ্চলের ভাষা শুনে যেমন ঢাকা মহানগরীতে বসবাসরত ওইসব অঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা মজা পান, তেমনি ‘অহনই যাওন লাগব’ শুনে পূর্বাঞ্চলের মানুষেরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন; কিন্তু পদ্মার ওপারের মানুষেরা তেমনধারা একাত্ম অনুভব করেন না। বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা সে অঞ্চলের জনজীবনকে তুলে ধরার জন্য চলচ্চিত্রে আসতেই পারে। কিন্তু যা সর্বজনীন বলে গ্রাহ্য হবে, সেখানে একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রমিত ভাষা আবশ্যক। আমাদের বাংলা ভাষার চলিত রীতি এই প্রমিত ভাষাকে তুলে ধরে। যাঁরা উদ্ভট আটপৌরে ভাষাকে প্রমোট করতে চাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো যুক্তি দেখাবেন ভাষা তো প্রবহমান নদীর মতো। ভাষার গতিও থেমে থাকে না। মিশ্রণে-সংমিশ্রণে ভাষা তার নব নব রূপ ধরে এগোতে থাকে। বিষয়টা ভিন্ন। এক ভাষায় অন্য সংস্কৃতির আগমনে ভাষার ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে পারে; কিন্তু ব্যাকরণশুদ্ধ ভাষারীতির পরিবর্তন হয় না। অনেকে বলতে পারেন, কথ্যভাষাও কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। মানুষ বিজ্ঞানের দ্রুততম যুগে পথ চলতে শুরু করেছে। দ্রুততা যেমন জীবনযাপনে, তেমনি কথাবার্তায়ও চলে আসবে−এ তো স্বাভাবিক। যেমন ইদানীং ইংরেজিতে want to-কে wanna, going to-কে gonna উচ্চারণ করা হচ্ছে। তেমনি দ্রততার জন্য ‘আমি এসেছি’ না বলে ‘আমি এসছি’ হতেই পারে। কিন্তু তা যদি কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে ‘আমি আইছি’ হয়, তবে তা সমগ্র দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
কয়েক দিন আগে টিভিতে ওই তথাকথিত আটপৌরে ভাষার একজন সম্মানিত সমর্থক সাময়িকী নামের একটা শিল্প-সাহিত্যালোচনার অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন। দারুণ স্নার্ট ও আকর্ষণীয় চেহারার ভদ্রলোক−মনে হচ্ছিল তাঁর কথার মধ্যে জোর করে তথাকথিত ঢাকাইয়া ভাষা আরোপের চেষ্টা করছিলেন। যেমন ‘ওটা আমরা করেছি’কে বলছিলেন ‘ওটা আমরা করছি’। অনেক সময় এসব উচ্চারণ ব্যাকরণের ‘কাল’কে বিভ্রান্ত করে। যদি কোনো তথ্য-প্রমাণের জন্য তিনি কোথাও হাজিরা দেন, এ ধরনের উচ্চারণ তাঁকে বিপাকে ফেলতে পারে।
অধ্যাপক মেহতাব খানম তাঁর যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র-নাটক-বিজ্ঞাপনগুলো খুবই উপভোগ্য, এতে সন্দেহ নেই। তাঁর মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের বাংলা ভাষা বিষয়ে দায়িত্বও কিন্তু কম নয়। আমাদের ভয়টা কোথায়? ‘ভাষার আগুনে দু ফোঁটা ঘি’ শিরোনামের প্রতিক্রিয়ায় (প্রথম আলো, ৮.১১.২০০৭) ফারুকীর মতামত উল্লেখ করে বলতে হয় পূর্ববাংলার বাংলা ভাষার অঢেল বৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই মনে রাখতে হবে যে নাটকের টিপিক্যাল ভাষা কিশোর বা তরুণদের গ্রাস করে যেন ওই ভাষাকেই প্রমিত করে না তোলার প্রয়াস পায়। কেননা আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষা করার অধিকার আমাদের সবারই। একটা মিথ্যাও দীর্ঘদিন ধরে সত্য বলে প্রচারিত হতে থাকলে, তা সত্যে পরিণত হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করেন। আমি কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে আসা ঢাকার অধিবাসী। আমার অঞ্চলের ভাষা নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ গর্বও আছে। কিন্তু ঢাকায় জন্নানো বা বড় হওয়া আমার ছেলেকে যদি জিজ্ঞেস করি−‘কিরে আজ টিভি দেখবি না?’ সে বলে, ‘আবার জিগায়’!

উম্মে মুসলিমা: প্রথম আলোর পাঠক।
lima_umme@yahoo.com ১২ নভেম্বর ২০০৭
.

Sunday, November 11, 2007

প্র তি ক্রি য়া: আটপৌরে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার

.
আটপৌরে বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারে সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র যখন কণ্টকাকীর্ণ তখন শুধু ভাষাবিষয়ক চিন্তকগণই নন, নানা পেশার সমাজমনস্ক চিন্তাশীল ব্যক্তিও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। ৬ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানমের ‘টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার’ শিরোনামে লেখায় এ ধরনের উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে।
ড. মেহতাব খানমকে ধন্যবাদ এ কারণে যে, তিনি আটপৌরে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরে লিখেছেন: ‘একটি মানুষ যখন শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলে নিজেকে কোথাও উপস্থাপন করে, তখন নিঃসন্দেহে সে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেটি তখন তার আত্মবিশ্বাসকেও কিন্তু অনেক বাড়িয়ে দেয়।’ আমরা এতদিন সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্র ও প্রচার মাধ্যমে আটপৌরে বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার না করার জন্য বলে এসেছি ভাষার ভিত্তি, বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার কথা চিন্তা করে। এখন বোঝা গেল, এ শুধু ভাষার ভিত্তি, বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার প্রশ্ন বা ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেও যুক্ত।
ইদানীং কিছু গল্প-উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে ব্যাপকভাবে আটপৌরে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে। টেলিভিশন নাটক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে এর ব্যবহার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এ প্রসঙ্গে আজ চারদিক থেকে সরব না হলে উপায় নেই। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, কর্পোরেট পুঁজি এবং বিদেশি লগ্নিকারী কথিত বড় কিছু প্রতিষ্ঠান টেলিভিশনের এসব নাটক ও বিজ্ঞাপনের অর্থ জোগানদাতা বা স্পন্সর। এসব অর্থ জোগান বা বিনিয়োগের উদ্দেশ্য সুদুরপ্রসারী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন আমাদের দেশের কিছু মেধাবী মানুষ; যারা চমৎকার গল্প বানাতে পারেন, বিজ্ঞাপন তৈরি করতে পারেন, বলতে পারেন আরও ভালো। তাঁদের কেউ বলছেন, ‘আমরা অভিনয় থেকে অভিনয়টা দুর করতে চাই।’ এ নতুন কোনো কথা নয়। ‘থার্ড থিয়েটার’-এর জন্নই হয়েছিল ‘জীবন থেকে উঠে আসে নাটক’-এর ধারণা নিয়ে। নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং অভিনয়ে কোনো কৃত্রিমতাকে প্রশ্রয় দিতেন না এর উদ্যোক্তারা। তাই বলে ভাষা ব্যবহারে তাঁরা আটপৌরে ছিলেন না; ঘরে ব্যবহারের শব্দ বা বাক্যরাজির সমাহারে তাঁদের সৃষ্টিকে সীমিত ও কণ্টকিত করেননি। ‘ওর মেসেজটা পাইয়াই আমারে ফাটাফাটি কইরা একটা ফোন মারবি, ঠিক আছে?’ বা ‘সকালে হ্যাব্বি নাশতা সাটাইছি, দুপুরে ক্ষুধাই লাগতাছে না।’ এ জাতীয় ভাষায় নাটকের সংলাপ রচনা বা বিজ্ঞাপনে বাক্য ব্যবহার ইদানীং টেলিভিশনের পর্দায় বড় কোম্পানিগুলোর স্পন্সর বা অর্থায়নে যদি হতেই থাকে, তবে বুঝতে হবে বাংলা ভাষার ‘মান’ তো থাকবেই না, ‘জান’ নিয়েও টানাটানি শুরু হবে।
অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে দেশপ্রেমকে অতিমাত্রায় জড়িয়ে দেন এবং বলেন এ রকম: ‘প্রমিত বাংলা বলে কিছু নেই। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে তা আসলে কলকাতার ভাষা। আমরা স্বাধীন দেশের কথ্য ভাষায় এসব সাহিত্য লিখি বা বিজ্ঞাপন বানাই।’ এ ধরনের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা মনে মনে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াকেই লালন করেন এবং তা সব অর্থেই সংকীর্ণ। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে, তা কলকাতার ভাষা নয়। কলকাতার যে ভাষারূপ তা সাবেক রাজধানী শহরের এক জাতীয় সংমিশ্রিত বাংলা। সাধুরীতির পরিবর্তে লিখিত গদ্যে চলিত রীতির ব্যবহার প্রচলনের সময়ই অর্থাৎ প্রায় শতবর্ষ আগে ভাষাচিন্তক ও সংস্কৃতিবোদ্ধারা অবিভক্ত বঙ্গের নানা অঞ্চলের ভাষা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা হবে এর আদর্শ। এরই ব্যবহারিক রূপ আজকের প্রমিত বাংলা। এই প্রমিত বাংলা বাংলাদেশেরও ভাষারূপ। কেননা, নদীয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা আজকের বাংলাদেশের তিনটি জেলা। ‘কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে’র বলে এই প্রমিত রূপকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। ড. মেহতাবও লিখেছেন: ‘যে দেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সে দেশের শিশুরা শুদ্ধ উচ্চারণে বলা প্রমিত বাংলার সঙ্গে অশুদ্ধ উচ্চারণকে পার্থক্য করতে শিখুক−সেটি আমরা চাই।’ এ রকম শুদ্ধ প্রত্যাশাই আজ জরুরি।
উনিশ শতকে শহর কলকাতায় যে ‘বাবু-কালচার’ তৈরি হয়েছিল এবং এর প্রভাব পড়েছিল বাংলা ভাষাতে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তেমনি শহর ঢাকাকে কেন্দ্র করে গুলশান-বারিধারার মতো স্থানে বাস করা অঢেল বিত্ত-বৈভবসম্পন্ন মানুষের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের ‘সাহেবি-কালচার’ তৈরি করেছে। তাদের ব্যবহূত আটপৌরে এবং মিশ্রভাষার প্রভাব এসে পড়ছে আমাদের ভাষায়। এ ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারই দেশপ্রেম প্রদর্শনের পথ, এ কথা সত্য নয়। কিছু গল্প-উপন্যাসেও এ ধরনের ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে এ জাতীয় ভাষার সীমিত ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হলেও এর যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে কাম্য নয়, অন্যান্য মাধ্যমেও অনুচিত। শিল্পীর ‘অধিকার’ বলে এই যথেচ্ছাচারে যাঁরা নিমজ্জিত হতে চান, তাঁরা কি জানেন, শিল্পীর শুধু ‘অধিকার’ নয়, তাঁর ‘দায়িত্ব’ও আছে!

ড. সৌমিত্র শেখর: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১১ নভেম্বর, ২০০৭

Thursday, November 8, 2007

প্র তি ক্রি য়া: ভাষার আগুনে দু ফোঁটা ঘি

.
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শ্রদ্ধেয়া মেহতাব খানমকে ধন্যবাদ। ৬ নভেম্বর প্রকাশিত ‘টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার’ লেখাটার জন্য। লেখাটি চিন্তার উদ্রেককারী। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার যথেষ্ট অনুপ্রেরণা লেখাটির মধ্যে রয়েছে।
তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে আটপৌরে ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন, বলতে দ্বিধা নেই, ঘটনাচক্রে আমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ফলে অভিযোগের দায়টা আমার ওপরেও এসে পড়ে। কানামাছি নামে একটা ভিডিও ছবিতে আমি সর্বপ্রথম কথ্যভাষার প্রয়োগ শুরু করি। এরপর ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করি চড়ুইভাতিতে। তারপর টিভি ধারাবাহিক একান্নবর্তী, সিক্সটি নাইন এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ব্যাচেলার-এ। সেই তাড়না থেকেই লেখা।
মেহতাব খানের লেখাটির দুটি দিক আছে। ভাষাতাত্ত্বিক ও চলচ্চিত্রগত। ভাষাতাত্ত্বিক দিকটা হলো, এত প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে ভাষা পেয়েছি সেই বাংলার ভাষায় হিন্দি, ইংরেজি ও আঞ্চলিকতার মিশেল চলতে থাকলে সেটা উদ্বেগেরই ব্যাপার। আমিও অংশত এই উদ্বেগের সঙ্গে একমত। এখনকার শিশু-কিশোরেরা যে হারে হ্যারি পটার, পকিমন ও ভিডিও গেমসের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমাদের যে রূপকথা-উপকথা রয়েছে, আজকের কিশোরেরা এর নাগালও পাচ্ছে না। তারা ঠানদিদির থলের চেয়ে ‘ডেথ অব হ্যালোজ’-এর কুয়া চেনে বেশি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ছেলেরা জাতীয় সংগীতের চারটা লাইনও বলতে পারবে না। সাত বীরশ্রেষ্ঠর নামও জানবে না। এরা হরিপদ কাপালি, পলান সরকারকেও চিনবে না। মনে-মগজে থাকবে আমেরিকা-ভারত। হিন্দি অথবা ইংরেজি। তথাকথিত বিশ্বায়নের খপ্পরে পড়ে ছোট জাতিগুলোর পক্ষে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন হবে। সংস্কৃতির এই যুগে টিকে থাকতে গেলে আমাদের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে মিডিয়াকে দ্বিগুণ শক্তিশালীরূপে আবির্ভুত হতে হবে।
কিন্তু আঞ্চলিকতা বহিরাগত কোনো ব্যাপার নয়, এটা যেকোনো ভাষারই অন্তর্গত ব্যাপার। আঞ্চলিকতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কিছু নেই। আঞ্চলিকতা ভাষারই অলংকার। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গে বাংলা ভাষা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষায় রয়েছে অঢেল বৈচিত্র্য। আঞ্চলিকতা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। তাই বলে সংবাদ উপস্থাপন, নিউজ রিপোর্টিং, অনুষ্ঠান উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাকে টেনে আনা চলে না। সব ভাষারই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রকাশভঙ্গি আছে। দুটোর ব্যবহার দুই ক্ষেত্রে। অনুষ্ঠান উপস্থাপক যদি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাষা মিলিয়ে উপস্থাপনা শুরু করেন, তাহলে অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার হবে। মেহতাব খানম বোধ হয় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ভাষা এক করে ফেলেছেন। ভেবেছেন, সংবাদ যেমন আনুষ্ঠানিক ভাষায় উপস্থাপিত হয়, চলচ্চিত্রেও তেমনটাই হওয়া উচিত। চলচ্চিত্রে বা টিভি মিডিয়ায় (যেটাকে তিনি টিভি নাটক বলেছেন, আসলে ভিডিও ছবি বা ডিজিটাল সিনেমা) ভাষার প্রয়োগ কী রকম হবে, সেটা ঠিক করতে হলে আগে জানতে হবে চলচ্চিত্রের দর্শন। এক কথায়, যে চরিত্র যে ভাষায় কথা বলার কথা, যে চরিত্রের জন্য যে পোশাক দরকার, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে তাকে সে ভাষাতেই কথা বলতে দিতে হবে, সেই পোশাকই পরাতে হবে। ৮০ বছরের বয়স্ক চরিত্রের জন্য যেমন আট বছর বয়সী শিশু উপযুক্ত নয়, নারীর চরিত্রের জন্য যেমন কোনো পুরুষকে মনোনীত করার সুযোগ নেই, তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও এই ডিটেইল রক্ষা করা জরুরি। আমরা পোশাকে, বয়সে, লিঙ্গের ব্যাপারে বাস্তববাদী হব, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে হব না−তা কীভাবে সম্ভব?
মেহতাব খানম লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অনেক আঞ্চলিক ভাষা থাকার কারণে আমরা নাটকের ডায়লগে সেগুলো প্রায়ই শুনতে পাই এবং সে পর্যন্ত থাকাটা ঠিকই আছে। সেই সঙ্গে যদি শুদ্ধ বাংলার চর্চাও কমে যায়, তাহলে আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারি।’ এ অংশটুকুর মর্ম আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা, তিনি বলতে চেয়েছেন, বরিশালের গল্প বরিশালের ভাষায় করা যাবে, কুষ্টিয়ারটা কুষ্টিয়ার ভাষায় কিন্তু ঢাকা শহরের গল্প হলে সেটাতে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে হবে। কে আমাদের বলে দিল ঢাকার প্যান্ট-শার্ট পরা সব মানুষ অভিন্ন মান বাংলায় কথা বলে? দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ঢাকায় এসে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা নতুন ধরনের কথ্যভাষার (মেট্রোপলিটন কলোকুয়ালের) জন্ন দিচ্ছে। এটার ব্যাপক বাস্তব রূপকে অস্বীকার করে একটা বানোয়াট বাস্তবতা তৈরি করলে তো হবে না। আবার এটাও ঠিক, কেউ কেউ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। আমার কাজগুলোর মধ্যে এ রকম বহু চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। যে টিভি ধারাবাহিকটার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন কিন্তু নাম বলেননি, সেই একান্নবর্তীতেও অনেকে প্রমিত বাংলায় কথা বলেছে। আমার সর্বশেষ ভিডিও ছবি ওয়েটিং রুমেও বলেছে। আবার অশুদ্ধ (!) ভাষাতেও বলেছে। যদিও আমি এটাকে অশুদ্ধ বলি না। বলি, কথ্য। আবার যারা আমার ছবিতে কথ্য ভাষায় কথা বলে, তারাও কখনো কখনো প্রমিত বাংলায়ও কথা বলে। ধরা যাক, নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে, তখন। অর্থাৎ বাস্তব জীবনে আমরা যেমনটা করি। আসলে ভাষা ব্যবহারের পুরোটাই পরিস্িথতি অনুযায়ী ঘটে।
শিশু-কিশোরেরা জগাখিচুড়ি ভাষা শিখে ফেলবে এই ভয়ে আমি আমার চরিত্রের ভাষা বদলে দেব? ধরা যাক, আমি একজন যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিকে নিয়ে ছবি বানাব। এখন যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে ছবি বানাতে গেলে তাঁর চরিত্রের অনেক খারাপ দিক, ঘৃণ্য দিক নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে হবে। কথা হচ্ছে, এসব খারাপ ক্রিয়াকর্ম দেখে কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা প্রভাবিত হয়ে খারাপ পথে ধাবিত হতে পারে−এই আশঙ্কা থেকে আমি কি যুদ্ধাপরাধীর চরিত্রের সব কালো দিক ধুয়ে ফেলে শুধু সাদা দিকগুলো দেখাব? এটা কি চলচ্চিত্রকারের দায়িত্বের আওতায় পড়ে? এটা যেমন তাঁর দায়িত্বের আওতায় পড়ে না, তেমনি তিনি চাইলেই কারও মুখে ‘ভালো ভাষা’ বসিয়ে দিতে পারেন না। অর্থাৎ কারও ওপর সদ্গুণ আরোপ করা কিংবা ‘সদ্ভাষা’ চাপিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্রকারের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না।
এবার ভাষা এবং ভাষার বিবর্তন বিষয়ে দুটো কথা বলতে চাই। ভাষা কোনো স্নৃতিসৌধের বেদির মতো অটল এবং স্িথর নয়। ভাষা বহতা নদীর মতো−এই উদাহরণ আমরা মুখে যতটা আওড়াই, মন দিয়ে ততটা বিশ্বাস করি বলে মনে হয় না। মান বাংলা পাল যুগে যে চেহারায় ছিল, ফোর্ট উইলিয়ামের কালে সে জায়গায় ছিল না। ফোর্ট উইলিয়ামের কালে যে জায়গায় ছিল, রবীন্দ্রনাথের কালে সে চেহারায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সময় যে জায়গায় ছিল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কালে আর সেখানে নেই। এই যে বিবর্তনটা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, এর বড় অনুঘটক হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষা, কথ্য ভাষা। এটা এমন নয় যে এটা সব সময়ই কিংবা পুরোটাই গবেষকের টেবিলে বিবর্তিত হয়। মানুষের মুখে মুখে বিবর্তিত হতে হতে অভিধান নতুন নতুন শব্দ পায়। ফলে কোনো একটা মান ভাষা আঁকড়ে ধরে ‘ভাষা-শাসন’ করা যায় না। অভিন্ন মান ভাষা অবশ্যই থাকবে। তবে তা স্িথর কিছু নয়, বিবর্তিত হবে এবং তা বহুলাংশে হবে রাস্তার বা মানুষের মুখে, গবেষকের টেবিলে নয়।
শেষ করতে চাই একটা শোনা কথা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের কালে বিশুদ্ধবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে প্রায়ই গালমন্দ করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বাংলা ভাষার বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার। একবার নাকি বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের কোনো একটা গল্পের একটা অনুচ্ছেদ হুবহু তুলে দিয়ে ছাত্রদের বলা হয়েছিল, লেখার ভুলগুলো সংশোধন করতে! সে প্রশ্ন রচনাকারী আজ কোথায়, বিদ্যালয় কোথায়, পরীক্ষা কোথায়, পরীক্ষার্থীই-বা কোথায়, আর রবীন্দ্রনাথ কোথায়!

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: চলচ্চিত্র নির্মাতা। ৮ নভেম্বর, ২০০৭
.

Tuesday, November 6, 2007

টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার

.
কিছুদিন আগে ‘একুশের রাতে’ অনুষ্ঠানে বেশ হালকা মেজাজের কথোপকথনের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উঠে এলেও সেগুলো নিয়ে সেদিন বিশদভাবে আলোচনা হয়নি। মনে হলো, সেদিনের পর্বটিকে উপস্থাপক খুব সিরিয়াস বিষয়বস্তু দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। তবে ওই আলোচনার দুটি বিষয়কে আমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়েছে বলে আমি এ নিয়ে ভবিষ্যতে আবার আলোচনা করার জন্য অনুরোধ রাখব। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে শিল্পী বা শিল্পের সামাজিক দায়ভার এবং অন্যটি হচ্ছে নাটকের ডায়ালগে আমাদের দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহার। দুটি বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্কের অবতারণা হতে পারে বা এর মধ্যেই হয়েছে বলে আমি মনে করি। এসব বিষয়ে কিছু ঐকমত্য তৈরি হলে পরবর্তী প্রজন্ন, বিশেষ করে এ দেশের শিশু-কিশোরেরা উপকৃত হবে। উল্লিখিত প্রথম বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক এবং দ্বিতীয় বিষয়টি প্রথমটির অন্তর্ভুক্ত। আমি আজ দ্বিতীয় বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে চাই। অর্থাৎ নাট্যকার তাঁর চরিত্রগুলোর কথোপকথনে স্বতঃস্কুর্ততা ও সাবলীলতা আনার উদ্দেশ্যে আমাদের ঘরে বলা দৈনন্দিন জীবনের ভাষাটিকে ব্যবহার করবেন কি না।
যে নাট্যকার বা কথাসাহিত্যিক এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে প্রথম এ ধারাটির অবতারণা করেছেন, তাঁর সেই নাটকটির প্রতিটি বিষয়বস্তু যে অসাধারণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ধারাটি যে নাটকটিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে, সেই নাট্যকারের রসবোধটি অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। একুশের রাতের সেদিনের আলোচনায় বলা হয়েছিল, শিল্পীর অধিকার রয়েছে তাঁর নিজের সৃষ্টিকে নিজের মতো করে পরিবেশন করার। আমার ভাবনাটি যে জায়গাটি থেকে তৈরি হচ্ছে তা হলো, আমাদের দেশের শিশুরা, যাদের প্রমিত বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন রয়েছে, তারা কোনটিকে মানদন্ড হিসেবে দেখবে। আজকালকার শিশু-কিশোর, আমরা জানি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতি খুব বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এই শক্তিশালী গণমাধ্যমে যদি তারা এ ধরনের বাংলা ভাষা শুনতে থাকে, তাহলে তাদের ভাষার বিকাশে এটি কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা কিন্তু আমাদের ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশে অনেক আঞ্চলিক ভাষা থাকার কারণে আমরা নাটকের ডায়ালগে সেগুলো প্রায়ই শুনতে পাই এবং সে পর্যন্ত থাকাটা ঠিকই আছে। সেই সঙ্গে যদি শুদ্ধ বাংলার চর্চাও কমে যায়, তাহলে আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়তেই পারি। কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা আজকাল বাংলা সাহিত্য খুব কমই পড়ছে। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, কবিগুরু রবীদ্রনাথ ঠাকুর এদের জীবনে প্রায় অনুপস্িথতই বলা যায়।
এ ছাড়া হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল, ইংরেজি গান ও ছবি, নানা রকম ডিজুস বাংলার ব্যবহার শিশু-কিশোরকে প্রমিত বাংলা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। মোবাইল ফোনের পাঠানো মেসেজে ইংরেজি শব্দের নানা রকম ভুল প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘আমাকে ফোন দিয়ো’, ‘ওর বিহেভ ভালো না’, ‘তোমাকে রিমাইন্ড দিচ্ছি’ ইত্যাদি। এ ছাড়া ই-মেইল, চ্যাটিং ইত্যাদিতেও শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার খুব কম দেখা যাচ্ছে। নানাভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে ভাষার ছড়াছড়ি করে চিঠি লেখার চর্চা তো বন্ধ হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। অনেকেই চর্চার মাধ্যমে তাদের বাংলাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার পরিবর্তে ভুল ইংরেজিতে কথা বলাকে বেশি সম্মানজনক মনে করছে।
এখনকার যুগের ছোট্ট শিশুদের আর ঠাকুরমার ঝুলি থেকে গল্প পড়ে শোনানো হচ্ছে না, যা তাদের কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করে তুলতে পারত। এ কারণেই তারা কিশোর বয়সে পা রেখে সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, শিবরাম চক্রবর্তী ও নীললোহিতের সঙ্গে আর আগের মতো পরিচিত হচ্ছে না। এ ছাড়া বিশেষভাবে কিশোরদের জন্য সংকলিত ম্যাগাজিনগুলো তাদের কাছে কতটা আদৃত হচ্ছে বা যথেষ্ট উন্নতমানের ম্যাগাজিন প্রকাশনার ব্যাপারে মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে কি না, আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমাদের দেশের কিছু লেখক কিশোরদের জন্য লিখছেন বটে, তবে এ যুগের মা-বাবারা সন্তানদের সেগুলো পড়তে কতটা অনুপ্রাণিত করতে পারছেন, সে ব্যাপারটিও খুব একটা আলোচনায় আসছে না। আগে যে পাড়াগুলোতে পাঠাগার ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত হতে বসেছে। প্রাক-বিদ্যালয় বয়সী শিশুদের জন্য তেমন কোনো আকর্ষণীয় সাহিত্য বা বইয়ের সিরিজ আমরা এখনো পাইনি। ইলেকট্রনিক যুগের জোয়ারে ঠাকুরমার ঝুলি, রাজা-রানির গল্প ভেসে গেছে অনেক দুরে। সেই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে নানা রকম কম্পিউটার গেম ও কার্টুন চিত্র। মা-বাবারা শিশুদের টেলিভিশন বা কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন। ছোট্টমণিদের হাতে বই তুলে দিতে হলে নিজেদেরও যেহেতু সময় দিতে হবে, সেহেতু তারা অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমকেই বেশি সুবিধাজনক মনে করছেন। এসব কারণে সঠিক উচ্চারণে শুদ্ধ বাংলা বলা বা লেখা শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের খুদে নাগরিকেরা।
এ সবকিছু পর্যালোচনা করে আমার যে কথাটি বারবার মনে হয়−আমরা যেন শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকারদের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে গিয়ে শিশু-কিশোরদের সঠিক ভাষা শেখার বিষয়টি বিস্নৃত না হই। তাঁরা হয়তো বলবেন, সাহিত্য বা নাটক তো বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা হয়, স্কুলের শিক্ষকদের দায়িত্বের ভার তো তাঁদের নেওয়ার কথা নয়। এ কথাটির উত্তরে আমি বলব, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুরা যেভাবে বইয়ের ভারে ভারাক্রান্ত অবস্থায় রয়েছে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে অনুপাত, সেখানে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমি বলব, কিছু নাটকে প্রতিদিনের বলা ভাষা ব্যবহূত হয়েছে এবং সেগুলো দর্শকনন্দিত হয়েছে বলেই এটিকে একটি আদর্শ হিসেবে আমরা যেন বিবেচনা করতে শুরু না করি। একটি নাটক অনেক কারণেই দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন তা তাদের স্নৃতিতেও থাকে−সেই কথাটি আমাদের মনে রাখতেই হবে। যখন বাংলাদেশে এত চ্যানেল ছিল না, শুধু বিটিভি দেখেই আমরা তৃপ্ত ছিলাম; তখনো এমন কিছু নাটক হয়েছে, যেগুলো আমরা আজও ভুলতে পারিনি। সেই নাটকগুলোতে তো আটপৌরে ভাষার ব্যবহার ছিল না।
আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য অসংখ্য পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ধারাবাহিক নাটক তৈরি হচ্ছে। এগুলোর যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে বলেই নাটক লেখা এবং নির্মাণের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন অনেকেই। প্রায় সব বয়সের ছেলেমেয়েরা যেহেতু অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে এগুলো দেখছে, এর মাধ্যমে যদি বিনোদনের পাশাপাশি কিছু মূল্যবোধ ও সঠিক ভাষা শেখানো সম্ভব হয়, তাহলে এতে বাড়তি পাওনা হবে বলেই মনে হয়। এ দেশের সম্মানিত নাট্যকার আর লেখকদের প্রতি তাই আমার অনুরোধ, তাঁরা যেন বিষয়টিকে একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন। কথাশিল্পীর স্বাধীনতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা দুটোরই ভারসাম্য কোনোভাবে করা যায় কি না সেটি বোধ হয় বের করা সম্ভব। যে দেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সে দেশের শিশুরা শুদ্ধ উচ্চারণে বলা প্রমিত বাংলার সঙ্গে অশুদ্ধ উচ্চারণকে পার্থক্য করতে শিখুক−সেটি আমরা চাই। শুদ্ধ উচ্চারণের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সচেতনতার বেশ অভাব বা কিছুটা উদাসীনতাও যে রয়েছে, সেটি অনেকেই স্বীকার করবেন। একটি মানুষ যখন শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলে নিজেকে কোথাও উপস্থাপন করে, তখন নিঃসন্দেহে সে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেটি তখন তার আত্মবিশ্বাসকেও কিন্তু অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা চাই আমাদের দেশের সন্তানেরা অন্তত একটি ভাষার ধারাকে প্রমিত বাংলা হিসেবে গ্রহণ করতে শিখুক। ভাষা নিয়ে তাদের বিভ্রান্তিগুলো দুর করার দায়িত্বটি শুধু নাট্যকার বা সাহিত্যিকদের ওপর দিলে তাঁদের প্রতি নিশ্চয়ই অন্যায় করা হবে। তাই আমি পরিশেষে বলব, এ বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদভাবে বিতর্ক ও সংলাপ চলুক, যাতে আমাদের শিশু-কিশোরদের মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবে মিশ্রভাষা ব্যবহারের প্রবণতা থেকে রক্ষা করার একটি উপায় খুঁজে পাওয়া যায়।

ড. মেহতাব খানম: অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৬ নভেম্বর, ২০০৭
.